প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিরাও আসামি
রফিক মৃধা, দিনকাল
প্রকাশ: ১০:৫৩ পিএম, ১৮ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৩৬ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সারাদেশে আবারও মিথ্যা মামলার হিড়িক চলছে। আবারও পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মামলায় আসামি করা হয়েছে অসুস্থ, প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিকে। মুন্সিগঞ্জে বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে যুবদল নেতা শাওন নিহত হলেও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে বিএনপি নেতাদের নামে। সে মামলায় আসামি করা হয় বিএনপির মৃত ব্যক্তির নামে। গাজীপুরে বিএনপির শোক র্যালিতে হামলা করেছে পুলিশ। উল্টো বিএনপি নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা করে পুলিশ। সেখানে প্রবাসে থাকা বিএনপি নেতা সোহরাব উদ্দিন ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নুরে আলমকে আসামি করা হয়। সোহরাব উদ্দিন দেশে ফিরে জামিন চাইলে তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পূর্বে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লাখের বেশি মামলা ও প্রায় ৩৯ লাখ আসামি করা হলেও নতুন করে আবারও মিথ্যা মামলার হিড়িক চলছে। মামলার আসামি থেকে বাদ যাচ্ছেন না বিএনপির মৃত ব্যক্তিরা। আগেও কবরে থাকা, বিদেশে থাকা, হজে থাকা, গুরুতর অসুস্থ থাকা বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়েছিল সরকার। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।
গত ২২ আগস্ট থেকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির ৪৮টি কর্মসূচিতে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২৮টি স্থানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। আর একই স্থানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশ থাকায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে ১৭টি স্থানে। এসব ঘটনায় যে ৪৬টি মামলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৬১টির বাদী পুলিশ। বাকি ১৭টি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা। সব জায়গায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে না বা সব পুলিশ এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে না। বিএনপির অভিযোগ, তাদের আন্দোলন কর্মসূচিতে রাশ টানতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একের পর এক হামলার পাশাপাশি পুলিশও বাধা দিয়েছে। এরপর এসব ঘটনায় উল্টো বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়া হয়েছে।
বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১১১০৭০টি মামলায় আসামির সংখ্যা ৩৯৭৪ ৪৮১ জন। হত্যা করা হয়েছে ১৫৩৭ জনকে। আইশৃঙ্খলা বাহিনী হত্যা করেছে ৭৯৯। গুম করা হয়েছে ১২০৪ জনকে।
গাজীপুর : গাজীপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মো. সোহরাব উদ্দিন চিকিৎসার জন্য গত ৪ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ছিলেন। গত ১০ অক্টোবর গাজীপুরে বিএনপির শোক মিছিলে হামলার ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ তাকে ৬ নাম্বার আসামি করে। দেশে ফিরে সোমবার বেলা ১১টায় তিনি ওই মামলায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণপূর্বক জামিন প্রার্থনা করেন। আদালত দুই দফা শুনানি শেষে তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন নজরুল ইসলাম বাচ্চু। মাসছয়েক আগে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাটে ২১ সেপ্টেম্বর বুধবারের সংঘর্ষের মামলায় তাকে আসামি করেছে পুলিশ। সংঘর্ষস্থলে না থাকলেও সাংবাদিক, জেলা ক্রীড়া সংগঠক, এমনকি ছাত্রলীগ কর্মীকেও আসামি করা হয়েছে। তবে যুবদলকর্মী শহিদুল ইসলাম শাওন ভূঁইয়া নিহতের ঘটনায় মামলা হয়নি। ফেরিঘাট এলাকায় শ্রমিক লীগের কার্যালয় না থাকলেও অফিস ভাঙচুরের অভিযোগেও মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে। মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিনহাজ-উল-ইসলাম বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে আসা মিছিলের ব্যানার কেড়ে নিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। বিএনপি কর্মীদের ছোড়া ইটপাটকেলে অতিরিক্ত এসপিসহ ৩৩ পুলিশ সদস্য জখম হন। সংঘর্ষে আহত যুবদলকর্মী শাওন ভূঁইয়া পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মস্তিস্কে গুলির আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতালের সনদে বলা হয়েছে। তাকেও আসামি করে মামলা দায়ের করে পুলিশ। পুলিশের মামলায় ৩১৩ জনের নামসহ অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। শ্রমিক লীগ নেতার মামলায় ৫২ জনের নামসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ : এক বছর যাবত দেশে নেই, অথচ বিদেশে থেকেই কোনো ধরনের অপরাধ না করেও মামলার আসামি হচ্ছেন প্রবাসীরা। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় বিএনপি, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১৩৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত দেড় হাজার জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলায় অন্যদের সঙ্গে আতিকুর রহমান লিটু (৪৫) ও মো. রাসেল (৩৫) নামে দুই প্রবাসীকে আসামি করা হয়েছে। আতিকুর রহমান লিটু ২০২১ সালের ২ আগস্ট ছুটি শেষে সৌদি আরবে ফিরে যান এবং মো. রাসেল দুই মাস ধরে দুবাইয়ে আছেন। সৌদি আরব প্রবাসী আতিকুর রহমান লিটু উপজেলা নারান্দী ইউনিয়নের ছোট আজলদী গ্রামের শাফিউদ্দিন পাঠানের ছেলে। দুবাই প্রবাসী মো. রাসেল উপজেলার চরফরাদী ইউনিয়নের চরতেরটেকিয়া গ্রামের ওয়াহাব মিয়ার ছেলে।
নেত্রকোনা : নেত্রকোনার কলমাকান্দায় গত ২৩ আগস্ট বিএনপির সভায় হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতারা দুটি মামলা করেছেন। তাতে মোট আসামি ৯৫ জন। এর মধ্যে খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী (৭৫), বাউসাম গ্রামের অসুস্থ শামছুল হক (৭৫), সুন্দরীঘাট এলাকার শারীরিক প্রতিবন্ধী মমরুজ খাঁর (৪৫) নামও রয়েছে।
আক্কাস আলী বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। ঘটনার দিন তিনি এলাকাতেও ছিলেন না। তারপরও তাকে আসামি করা হয়েছে। আরেক আসামি শামছুল হক এক সময় ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করেন তার ভাতিজা খারনৈ ইউপির চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল।
তিনি বলেন, আমার চাচা চোখে কম দেখেন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের কারণে তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। তাকে দুটি মামলার আসামি করা হয়েছে।
সর্বশেষ ময়মনসিংহে জনসভা শেষ করে ফেরার পথে বিএনপির কর্মীদের ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগ। পরে বিএনপির ৪ শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ।