পানিতে ভর্তুকি বন্ধের ঘোষণায় মধ্যবিত্তের কপালে চিন্তার ভাঁজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪৩ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:২১ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক রোডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। ভাড়া থাকেন চারতলা একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। ১৪ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন বাসা সংলগ্ন একটি ফার্নিচারের দোকানে। এখন তিনি যে বাসায় থাকেন, ভাড়ার সঙ্গে তাকে ঢাকা ওয়াসার প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য ১৫ টাকা ১৮ পয়সা দাম দিতে হয়। ঢাকার আরেক অভিজাত আবাসিক এলাকা বনানী। এই এলাকার ১১ নম্বর রোডের ইকবাল মাহমুদ। তিনি একটি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যবসায় বিনিয়োগ প্রায় হাজার কোটি টাকা। পরিবার নিয়ে এই রোডের চারতলা একটি বাড়িতে একাই থাকেন। তিনিও প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য ১৫ টাকা ১৮ পয়সা হারে দাম দিচ্ছেন। ঢাকা ওয়াসার পানির দাম নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এই দুই ব্যক্তির আয় এবং পেশার কথা উঠে এসেছে।
সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এই ভর্তুকি অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি, বনানী, গুলশানের ধনীরাও পাচ্ছেন। আবার একই দামে বস্তির মানুষকেও পানি কিনতে হচ্ছে। তাই পানিতে ভর্তুকি বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ওয়াসা। শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসার পানিতে ভর্তুকি দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ঢাকায় জোনভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করে বস্তিতে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষকে কম দামে পানি দেয়া হবে। গুলশান-বনানীতে বসবাসকারীরা যে হারে পানির বিল দেন বস্তিতে থাকা অথবা যাত্রাবাড়ীতে থাকা মানুষ কেন সমান পানির মূল্য পরিশোধ করবে। ঢাকায় জোনভিত্তিক পানির দাম আলাদা করে বাড়ানো হবে। গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকায় পানির দাম বেশি থাকবে। নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাসরত এলাকায় পানির দাম থাকবে অপেক্ষাকৃত কম। ঢাকা শহরে পানিতে ভর্তুকি দেয়া হবে না।
মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর পানির দাম কোন অঞ্চলে কত বাড়ানো হবে, তা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। নাগরিকদের একাংশ বলছেন, শুধু গুলশান, বানানী, ধানমন্ডি দিয়ে পুরো ঢাকাকে বিচার করলে হবে না। ঢাকা শহরে দুই-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্ত। এখন এলাকাভিত্তিক পানির দাম বাড়ানো হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর চাপ বাড়বে।
আরেকটি পক্ষ বলছে, ওয়াসার এই উদ্যোগ যুক্তিসঙ্গত। বস্তিবাসী বা নিম্নআয়ের মানুষের পানিতে ভর্তুকি দিয়ে উচ্চবিত্তদের বিল বাড়াতে হবে। ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, এখন এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে ঢাকা ওয়াসা খরচ করে ২৫ টাকা। কিন্তু আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য দাম দিতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বাকি ১০ টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। এভাবে প্রতি বছর শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার সাতটি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। বিপুল ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছিল ২০১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এমন বাস্তবতায় আবাসিকে এক হাজার লিটার পানির জন্য ১৯ টাকা এবং বাণিজ্যিক সংযোগে পানির দাম ৫০ টাকা (বর্তমানে ৪২ টাকা) করতে চাইছে ঢাকা ওয়াসা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, আবাসিকে পানির দাম ১৯ টাকা ও বাণিজ্যিকে ৫০ টাকা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এ বিষয়ে গত ৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। তবে ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে দাবি করেছেন রাজধানীর মহাখালীর আমতলীর বাসিন্দা হাসান উদ্দিন।
তিনি বলেন, ওয়াসা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি সরকারি সেবা সংস্থা। এই সংস্থা ভর্তুকি দিয়ে চলবে, এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অর্থনৈতিক সংকটে আছেন। এখন দাম বাড়ালে বা ওয়াসার পানিতে সরকার ভর্তুকি না দিলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বেন মধ্যবিত্ত। তাই বিষয়টি ওয়াসাসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদ গলির বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, অভিজাত এলাকা আর বস্তি এলাকায় পানির দাম এক হতে পারে না। এখন সরকার অভিজাত এলাকায় পানির দাম বাড়াতে পারে। কিন্তু কোনো ক্রমেই যাতে এর প্রভাব মধ্যবিত্ত বা ভাড়াটিয়াদের ওপর না পড়ে। ঢাকা শহরে মোট জনসংখ্যার গড়ে ৮০ শতাংশ ভাড়াটিয়া বা মধ্যবিত্ত বলে জানান ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সম্প্রতি তেলের দাম বাড়ানোর পর বাসাভাড়া বাড়াতে বাড়ি মালিকেরা অসুস্থ প্রতিযোগিতা করছেন। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামও বেড়েছে। এখন পানির দামও যদি বাড়ানো বা ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হয়, ভাড়াটিয়াদের ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ পরিস্থিতি হবে। এ বিষয়ে জানতে শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ওয়াসা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া মেলেনি। ওয়াসার পানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপদ পানি ন্যায্যমূল্যে পাওয়া এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া মৌলিক অধিকার। এখন ওয়াসা জোনভিত্তিক পানির দাম বাড়ানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ঘুরেফিরে এই চাপ মধ্যবিত্তদের ওপরই পড়বে।