আজ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:২৯ এএম, ৩০ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৫৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আজ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। বাংলাদেশে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের অধিকাংশই আর ফিরে আসে না। কখনো সাদাপোশাকে, কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাদের তুলে নিয়ে যায়। কারোর লাশ পাওয়া যায়, কেউ জীবিত ফেরার পর চুপচাপ হয়ে যান। তবুও এইসব গুম বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা স্বজনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন। ‘নিখোঁজ’ এসব ব্যক্তির নাম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস কমিশনের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গুম হওয়া মানুষের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। এই তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের পাশাপাশি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুস্তক প্রকাশক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় বক্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তা। গুম হওয়া পরিবারের স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
২১ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত ‘গুম, খুন আর না’ শীর্ষক সভায় ২০১৩ সালে গুম হওয়া মো. সোহেলের মেয়ে সাবা ইসলাম বলেন, আমার বাবাকে কারা নিল? আমি বাবাকে দেখতে চাই, কথা বলতে চাই। সবার বাবা আছে, আমার বাবা কই? আমার আর ভালো লাগে না। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। সভায় নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। এতে গুমের শিকার অর্ধশতাধিক ব্যক্তির স্বজন অংশ নেন। তাদের কারও বুকে সন্তানের, কারও বুকে বাবার, কারো বুকে স্বামীর আবার কারও বুকে ভাইয়ের ছবি ঝুলছিল। এ সময় স্বজনহারা মানুষ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
গুমের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। বাবাকে ফিরে পেতে শাহীনবাগ এলাকা থেকে সভায় উপস্থিত হয় হাফসা ইসলাম। হাফসা জানায়, তার বাবা সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হন। তখন সে খুব ছোট। হাফসা এখনো বাবার অপেক্ষায় থাকে। যখন তার বাবা নিখোঁজ হন, তখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। হাফসা বলে, আমার বাবার চেহারাটাই মনে আছে। ছবি দেখে আর কিছু মনে করতে পারি না। একই বছর নিখোঁজ হন বংশালের ১২ বছর বয়সী শিশু শাকিলা সুলতানার বাবা মো. সোহেল। তিনি বংশাল থানা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। বাসা থেকে তাকে তুলে নেয়া হয় বলে জানায় পরিবারের অন্য সদস্যরা। ২০১৯ সালে বাবা ইসমাইল হোসেন বাতেনকে হারানো আনিসা ইসলাম বলেন, আমার বাবা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ২০১৯ সালের ১৯ জুন বাবাকে মিরপুরের দোকান থেকে একটি বাহিনীর লোকজন নিয়ে যায়। এরপর সংশ্লিষ্ট সব স্থানে লিখিত অভিযোগ করা সত্ত্বেও কোনো সুরাহা হয়নি। আমি জানতে চাই, আমার বাবার দোষ কী? সভায় স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি জানান ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রামপুরা থেকে গুম হওয়া ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগ থেকে গুম হওয়া সাজিদুল ইসলাম সুমনের বোন মারুফা আক্তার, ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গুম হওয়া নূর আলমের স্ত্রী রীনা বেগম, ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল রাজধানীর সানারপার থেকে গুম হওয়া ইকবালের স্ত্রীর ভাই মোস্তফা কামালসহ অন্তত ৩৫টি পরিবারের সদস্য।
এদিকে গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাণী দিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বাণীতে বলা হয়, ৩০ আগস্ট, সারাবিশ্বে বিভিন্ন সময়ে গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের স¥রণে আন্তর্জাতিক দিবস। হারিয়ে যাওয়া মানুষদের স¥রণে জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসটি ২০১১ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে শত-শত গুমের ঘটনায় বাংলাদেশিরা আজ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীসহ অন্যান্য যারা গুম হয়েছেন তাদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং নিখোঁজ মানুষদের পরিবারের প্রতি জ্ঞাপন করছি সমবেদনা। এমন বাস্তবতার মধ্যে বিশে^র অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে আন্তর্জাতিক গুম দিবস।
গুম এখন বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভিন্নমতের মানুষদের নির্মূল করার প্রধান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা এই হাতিয়ার ব্যবহার করে যথেচ্ছভাবে। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই গুমের শিকার হয়েছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। পরিবার-পরিজন থেকে হারিয়ে গেছে প্রিয় মানুষটি। দেশে বিরোধী দল-বিরোধী মত ও বিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাস দমন করার জন্য সমাজে সন্ত্রাস ও ভয় সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বর্তমান সরকার নির্বিচারে গুমকে ব্যবহার করে আসছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে অব্যাহতভাবে গুম করা হচ্ছে সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ মানবাধিকার কর্মী, লেখক, সাংবাদিক, সাধারণ ছাত্র-যুবক এমনকি গৃহবধূও। তারা জীবিত না মৃত তা জানা নেই। এদের মধ্যে কয়েকজনকে ফেরত দিলেও বাকিরা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী, সাইফুল ইসলাম হিরু, কাউন্সিলর চৌধুরী আলম, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামসহ ছাত্র, যুবক, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, মুক্তমনা মানুষকে গুম করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে দুই মাস গুম করে রাখার পর পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিমূর্লের এই মনুষ্যত্বহীন সংস্কৃতি বাংলাদেশে ছিল না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই কেবলমাত্র এই পৈশাচিক সংস্কৃতি চালু করে। অধিকাংশ পরিবারই অভিযোগ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়েই তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। মানুষের এখন জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই।
বর্তমানে যেদেশে জীবন্ত মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায় সেই দেশে জঙ্গলের আইনই চলে। এইসব গুমের সাথে রাষ্ট্র জড়িত। বাংলাদেশে শত শত গুমের হোতা হচ্ছে সরকারী এজেন্সীগুলো। যার নতুন ঠিকানা ফাঁস হয়েছে ‘আয়নাঘর’ নামে। গুম হচ্ছে অখন্ড কর্তৃত্ববাদী বর্বর শাসনেরই অনুসঙ্গ। গুম হওয়া পরিবারগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয়জনকে ফেরত পাওয়ার জন্য। দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য জনগণের মিলিত কন্ঠে বর্তমান অপশাসনের অবসানের জন্য আওয়াজ তুলতে হবে। গুম করা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। গণতন্ত্র ফিরে আসলেই জবাবদিহিতা ফিরবে এবং গুমের অবসান হবে।
‘গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে অপর এক বাণীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বলেছেন, ৩০ আগস্ট ‘গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের স্মরণে আন্তর্জাতিক গুম দিবস’ উপলক্ষে আমি হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছি। তাদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। বাংলাদেশে গুমের আতঙ্ক এখন সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। দুঃশাসন থেকে উৎপন্ন হয় গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যার মতো মানবতা বিরোধী হিংস্রতা। স্বৈরাচারী সরকারের গড়ে তোলা আইন প্রয়োগকারি সংস্থার পরিচয়ে বিরোধী দলের প্রতিবাদি নেতাকর্মীদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া এখন নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা বিরোধী দল ও মতের মানুষদের অল্পদিন-দীর্ঘদিন অথবা চিরদিনের জন্যে নিখোঁজ করে দেয়। গুম হচ্ছে একদলীয় দু:শাসনের নমুনা। রাষ্ট্রের এই অমানবিক আচরণ সংবিধানবিরোধী। ‘যেকোন দেশের নাগরিকের জীবন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব’। বর্তমান শাসকগোষ্ঠি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে গুমকে করে তুলেছে সরকারের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি।
তিনি বলেন, সরকারবিরোধী দল ও ভিন্ন মতের মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যই তারা এই কর্মসূচি জোরেশোরে বাস্তবায়ন করছে। বিরোধীদলশূন্য একদলীয় শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যই গুমকে প্রধান অবলম্বন করা হচ্ছে। এই নির্দয় গুমের শিকার হয়েছেন সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী, সাইফুল ইসলাম হিরু ও চৌধুরী আলম, সুমন, জাকিরসহ ছয় শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী। আরেকটি লোমহর্ষক গুমের শিকার হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তাকে দুই মাস গুম করে রাখার পর পাচার করা হয়েছে পাশের দেশে। এই নতুন ধরনের ঘটনা দেশবাসীকে মহা আতঙ্কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গুম হওয়া মানুষদের বেদনার্ত পরিবাররা এখনও পথ চেয়ে বসে আছে প্রিয়জনদের ফিরে আসার সম্ভাবনায়। গুম হওয়ার পর গুমের শিকার পরিবারগুলোর ওপরও চলতে থাকে সরকারি নির্যাতন। গুমের অব্যাহত পরিস্থিতিতে দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়ঙ্কর নৈরাজ্য। এই ধারা বয়ে চললে বাংলাদেশ আদিম অরণ্যের অন্ধকারে ডুবে যাবে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আসুন, আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধ হই। কেবলমাত্র একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হলেই গুম, অপহরণ, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ দূর হবে, জন-জীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে। আমি জাতিসংঘের অধীনে সকল গুমের তদন্তের দাবি করছি।