বছর গড়ায় তবু শেষ হয় না তদন্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:১০ এএম, ২৮ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫৩ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বছরের পর বছর যায়, তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না- এমন মামলার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে এগুলোর মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলা ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে। ১০ বছর পেরোতে চললো, এখনও জমা পড়েনি প্রতিবেদন। আদালত থেকে দফায় দফায় সময় বেঁধে দেয়ার পরও এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করে প্রতিবেদন দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
প্রসিকিউটর ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আর কোনো মামলার প্রতিবেদন জমা হতে এত দীর্ঘ সময় লেগেছে বলে তাদের জানা নেই। ‘ক্লু-লেস’ মামলার তদন্তে সময় লাগলেও বছর চারেকের মধ্যেই সেগুলোর সমাধান হতে দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসলামবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলার প্রতিবেদন ৮ বছরেও আদালতে জমা হয়নি। ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আসতেও সময় নিয়েছে চার বছর। আদালতে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার প্রতিবেদন জমা দিতে তিন বছর লেগেছে তদন্ত সংস্থার। সাগর-রুনি হত্যা মামলার জন্য গত ১০ বছরে আদালত থেকে ৮৩ বার সময় নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। তবু আলোচিত ওই হত্যাকান্ডের কিনারা করতে পারেনি র্যাব। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেদিন রাতে রুনির ভাই নওশের আলম রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার বাবুলের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায়ও তদন্ত প্রতিবেদন করতে লেগে গেছে কয়েক বছর। এখনও মামলার কূলকিনারা হয়নি। এসপি বাবুলকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত এ মামলায় সুবিচার পাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল মুনিয়া হত্যা। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর সুবহানের বিরুদ্ধে মুনিয়ার বোন হত্যা মামলা দায়ের করলেও পুলিশ সে মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। পরে মুনিয়ার বোন পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়েছেন। এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
বছরে কত হত্যা? : বছরে কত হত্যা ঘটে তার কোনো সার্বিক চিত্র তুলে ধরা যায় না। একেক সংস্থা একেক ধরনের হিসাব লিপিবদ্ধ করে। আবার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে সংখ্যা নির্ধারণ করায় সেটি যে প্রকৃত তা বলা যায় না। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, কোনটা হত্যা সেটা নির্ধারণেও অনেক বিতর্ক থাকায় সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব বলছে, গত ৫ বছরে বন্দুকযুদ্ধ ও পুলিশ কাস্টডিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৮ সালে ৪৪৬ জন। আর চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধ ও পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যু হয়েছে ৬৭ জনের, রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৩০ জনের, সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ১৪ জন, জেল কাস্টডিতে মৃত্যু হয়েছে ৭৮ জনের ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জনকে, গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের ও যৌতুক-সংক্রান্ত নির্যাতনের পর মৃত্যু হয়েছে ৬৬ জনের। হিসাব বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বন্দুকযুদ্ধ ও পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যু তুলনামূলক কম। এসব মামলার তদন্ত কত শতাংশ শেষ করা সম্ভব হয়েছে তার কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। কেবল আলোড়ন সৃষ্টিকারী মামলাগুলোর ক্ষেত্রেই মিডিয়া মনিটরিং থাকায় মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা যায়।
চাঞ্চল্যকর মামলা, দেরিতে প্রতিবেদন : ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ইসলামবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। এ হত্যা মামলার প্রতিবেদন ৮ বছরেও আদালতে জমা হয়নি।
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী : ঘটনার পরদিন নুরুল ইসলামের ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-নয়জনকে আসামি করে শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজন হিসেবে জেএমবি, আনসারুল্লাহ ও হুজির ১৩ সদস্যসহ মোট ১৬ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। তাদের মধ্যে ১২ জন এখনও কারাগারে। ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আসতে সময় নিয়েছে চার বছর। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়। চার বছর পর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়। প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার প্রতিবেদন আদালতে তিন বছর পর জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর দুপুরের পর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দীপনকে। দীর্ঘ তিন বছর পর তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
তনু হত্যা তদন্ত : কর্মকর্তা বদলায়, ক্লু মেলে না : চলতি বছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকান্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। পাঁচ বছরে আলোচিত এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে পাঁচবার। তবু কোনো আসামি শনাক্ত হয়নি। সূত্র জানায়, এখন মামলাটির দায়িত্বে আছেন ঢাকা পিআইবি-এর ডিআইজি।
সোহাগী জাহান তনু : সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর পাওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত তদন্তেই ঝুলে আছে মামলা। অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ তনুর পরিবার। তাদের অভিযোগ, ‘ক্ষমতা’ না থাকায় আজ তারা বিচার পাচ্ছেন না। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরে একটি কালভার্টের ২০-৩০ গজ দূরে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয় তনুর লাশ। পরদিন বিকালে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
আলোচিত সালমান শাহ মামলা : ঢালিউডের এই সুপারস্টারের মৃত্যু নিয়ে যে রহস্য তৈরি হয়, তার জট খুলতে লেগে যায় ২৫ বছর। শেষ পর্যন্ত চলতি বছর ৩১ অক্টোবর ঢাকার আদালতে এই মামলা পরিসমাপ্ত হয়। সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছেন- মর্মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেয়া প্রতিবেদন গ্রহণ করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ। একইদিনে সালমান শাহর মায়ের পক্ষে আইনজীবীর করা নারাজি ও মা নীলা চৌধুরীর জবানবন্দি গ্রহণের আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলাটির পরিসমাপ্তি টানেন আদালত।
সাগর-রুনি হত্যা মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি : গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চান। ৫ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব ফোর্সেস সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ৭ জুলাই থেকে মামলাটি তদন্ত করছেন তিনি। আগের কর্মকর্তা আটজন আসামিকে গ্রেফতার করেছিলেন। তাদের ছয়জন জেল-হাজতে, দুজন জামিনে মুক্ত। জব্দকৃত আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইএফএস (ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস)-এ পাঠানো হয়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আলামতে অজ্ঞাতনামা দুই পুরুষ ব্যক্তির ডিএনএ’ও পাওয়া গেছে। তদন্তকালে তাদের চিহ্নিত করতে প্যারাবন স্ন্যাপশট নামের আরেকটি আমেরিকান ডিএনএ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
সাগর-রুনি : এ মামলায় সর্বশেষ গত ২৪ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় আগামী ২৬ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়। মামলার অগ্রগতি নিয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘সাগর-রুনি মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনও কোনো ক্লু পাচ্ছেন না। তাই বারবার প্রতিবেদন পিছিয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো আসামির সম্পৃক্ততা না-ও পাওয়া যায়, তবু দ্রুত একটি প্রতিবেদন দেয়া হোক।’ আর কোনো মামলার তদন্তে এতো সময় লাগতে দেখেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো মামলায়ই একেবারে ‘ক্লু-লেস’ থেকে যেতে পারে না।’ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, ‘এ ধরনের হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেয়া না হলে হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্ট আলামতগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’ মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘ক্ষমতাবান বা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার যদি সম্পৃক্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে, তখন সেসব মামলা খুব বেশি এগোয় না। ফলে যতজনের সামনেই অপরাধ সংঘটিত হোক না কেন, একটু সময় নিয়ে মূলত সেটা মানুষকে ভুলিয়ে দেয়া হয়।