বিএনডব্লিউএলএর রিপোর্ট
দেশে নারী নির্যাতন ও সহিংসতা বেড়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫৭ এএম, ২২ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫১ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৪
দেশব্যাপী নারী নির্যাতন ও সহিংসতা বাড়ার ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিটি ক্ষেত্রেই উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ নারী ক্রমাগত রাস্তা, যানবাহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি বাড়িতেও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী- ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা ১১৯৪টির মধ্যে ৪৮৯ জন নারী ও ৭০৫ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা সর্বজনীন ও আন্তর্জাতিক। সমাজব্যবস্থার আদি থেকেই সহিংসতা তথা নির্যাতনের সূচনা। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার মূল কথা হলো পুরুষের সীমাহীন আধিপত্য ও নারীর অধীনতা নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি সব সমাজ প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন হলেও এর প্রধান কারণগুলো সকল সমাজব্যবস্থার মধ্যে প্রায় একই রকম।
জাতিসংঘের মতে- নারী নির্যাতন হলো শারীরিক, মানসিক, জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘনমূলক ব্যবস্থা। বেইজিং ঘোষণায় নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে বোঝানো হয়েছে-
১। পরিবারের অভ্যন্তরে শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন। যেমন- প্রহার, কন্যা শিশুর যৌন নিগ্রহ, যৌতুক সংক্রান্ত নির্যাতন এবং অন্যান্য প্রথাগত যন্ত্রণাদায়ক রীতি, স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি দ্বারা নির্যাতন।
২। সমাজের মধ্যে নারীর প্রতি শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন। যেমন- ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, যৌন হয়রানি এবং কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভীতি প্রদর্শন। নারী অপহরণ এবং জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো।
৩। নারীর প্রতি সহিংসতা আচরণ ও নির্যাতন বলতে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় হত্যা পরিকল্পিত ধর্ষণ যৌন দাসত্ব এবং জোরপূর্বক গর্ভধারণও বুঝায়।
নারী নির্যাতনের ধরন বহুমাত্রিক। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে হয়ে থাকে। সময়ের পালা বদলে নারীর প্রতি সহিংসতার রূপ ও ধরন বদলে গেছে। বর্তমান সময়ে চলমান ডিজিটাল মাধ্যমে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হলেন নারী। সাইবার অপরাধ সাইবার বুলিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, ভাইভার, টুইটার ইত্যাদি মাধ্যমে নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সংবিধানের ২৮(২) ধারায় বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবেন। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি এটি একক এবং বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়। সমাজের সদস্য হিসেবে সবারই দায়। কেউও এই দায় এড়াতে পারে না। এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর নির্যাতন নারীর অধিকার তো হরণ করেই একই সঙ্গে দেশের উন্নয়ন-প্রগতি-শান্তি-শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করে। তাই সহিংসতা বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা তথা সচেতনতা খুব জরুরি। মানবিকতা, সহমর্মিতা পারস্পরিক বোঝাপড়া অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান দেখানোর মতো মানসিকতা তৈরি হবে। সমাজে বিরাজমান মানসিক কুসংস্কার গোঁড়ামি অপসংস্কৃতি ফতোয়াসহ অজ্ঞতা অপরিণামদর্শিতার বিষয়টি সমাজ থেকে নির্মূল করতে নানা উপায় অবলম্বন করতে হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সমাজ থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ করতে হবে এক্ষেত্রে পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে কিছুটা হলেও সহিংসতা কমে আসবে। পরিবর্তন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। সবকিছুতেই পরিবর্তন এসেছে কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের ইতিবাচক চিন্তার জায়গাটি এখনও অনেক দূরে। তাই তো এখনও নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র দেখতে পাই। শুধু আইন, শুধু আবেগের তাড়নায় তাড়িত না হয়ে বাস্তবভিত্তিক সময়পোযোগী চিন্তা ভাবনার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আইন সংস্কার সংশোধন পরিবর্তন করতে হবে। করতে হবে নারীবান্ধব আইন। আইনি সহায়তায় এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ বন্ধ করতে হবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং আইনি সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে একযোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বিভিন্ন সভা সেমিনার প্রচার-প্রসারের স্বার্থে বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন রেডিও, টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকা পাঠ্যপুস্তকে নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সভ্যতার স্বার্থে উন্নতি-প্রগতি ও সমৃদ্ধিশালী আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে তথা সোনার বাংলা গড়তে সুখী-সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে এ বিশ্ব সমাজ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে। নারী-পুরুষের সমান তালে সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে কৃতিত্বের সোনালী স্বাক্ষর রেখেই চলেছে।
পরিশেষে বলা যায়, সকলের আন্তরিক চেষ্টায় তথা সচেতনতায় এ সমাজ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে স্বাভাবিক সুন্দর-সাবলীল-সোহার্দ্য-সম্প্রীতি-শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্কের বন্ধন অটুট থাকবে। সেই সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। মানবতার জয় হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।
উল্লেখ্য, গত রবিবার চট্টগ্রামে আইনজীবী স্বামীর নির্যাতনে মাহমুদা খানম ওরফে আঁখি নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়াও গত ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে স্বামীর নির্যাতনে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নৃত্যকলা বিভাগের ছাত্রী এলমা চৌধুরী। তার শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায় বলে চিকিৎসকগণ জানান। এসব সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ঘটনাগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদেরকে শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহবান জানাচ্ছে।
সালমা আলী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এসব ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে অগণিত নারী ও শিশু হত্যার বিচারহীনতার মধ্য দিয়ে দেশের সমগ্র নারী ও শিশুরা অনিরাপত্তায় থাকবে।