বিদেশের কাছে দেনা বাড়ছেই
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:২৮ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৫২ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দেশের উন্নয়নে বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে অনেক। কিন্তু রাজস্ব ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় কম। ঘাটতি পূরণে তাই বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে ৬৭৭ কোটি ডলার। নতুন অর্থবছরের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যে বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তাতে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আগের অর্থবছরে ঋণ পাওয়া গিয়েছিল ৬৭৪ কোটি ডলার। এখন বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার। এদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশ বছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ ছিল ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সাল শেষে যা দাঁড়ায় ৫৭ বিলিয়ন ডলারে।
দুশ্চিন্তা নেই, বলছেন অর্থনীতিবিদরা :
অবশ্য ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ দেখেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বিদেশি ঋণ বাংলাদেশের দুর্বলতা নির্দেশ করে না। কারণ অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে ১০ বছরে। ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাও বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘১০ বছরে রফতানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলাপি হয়নি। তাই দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বড় প্রকল্পের জন্য স্বল্প সুদে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন আছে। তবে ওই ঋণ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারলে অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে বাজেট বাস্তবায়ন, রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়বে।’ অর্থমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার সঙ্গে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ঋণচুক্তির পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৯০৮ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৫৯ হাজার ৪৫৮ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। অপেক্ষায় আছে ৪৬ হাজার ৪৫০ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ সালে বিদেশি ঋণ ছিল ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সাল শেষে দাঁড়ায় ৫৭ বিলিয়ন ডলারে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের মার্চে এসে বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে।
বেড়েছে ঋণ-রফতানি অনুপাত :
২০১৫ সালে রফতানির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ দশমিক ২ শতাংশে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ ও চলতি হিসাবের অনুপাতও বাড়ছে। ২০১৫ সালে চলতি হিসাবের তুলনায় বৈদেশিক ঋণ ছিল ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ১১১ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আরও কৌশলী হতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকলে বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা আরও বাড়বে।’ জানা গেছে, বর্তমানে বৈদেশিক ঋণনির্ভর বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। এ প্রকল্পে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণে জাইকা দিয়েছে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে জি-টু-জির মাধ্যমে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন। এছাড়া ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল (উত্তরা-মতিঝিল, এআরটি লাইন-৬) প্রকল্পেও ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জাইকা। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে ১১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এডিবি। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন। এই বছরের মার্চ পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী, দেশে দ্বিপক্ষীয় দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১ হাজার ৭৭১ কোটি ৭১ লাখ ডলারের বেশি। এর মধ্যে সরকারের ঋণ ১ হাজার ৭৫১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। বেসরকারি খাতে ২০ কোটি ২৮ লাখ ডলার। রাশিয়া, চীন ও ভারতের বড় ধরনের ঋণ প্রস্তাব রয়েছে। এগুলো গৃহীত হলে সামনের দিনগুলোয় বৈদেশিক ঋণ আরও বাড়বে। এবারের এডিপিতে ১ হাজার ৫৩৮টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে বাস্তবায়নাধীন বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প আছে ৩৬৫টি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৭৬ ডলারে। ঋণ গ্রহণে জটিলতা, বিভিন্ন সারচার্জ এবং অবকাঠামো সমস্যার কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এখন বৈদেশিক ঋণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের ঋণ-অনুদান মিলে মোট ৭১১ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ ৬৭৭ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঋণ-অনুদান মিলে পাওয়া গিয়েছিল ৭২৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ঋণ ছিল ৬৭৪ কোটি ডলার, বাকিটা অনুদান। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিদেশি সহায়তা পায়। বহুপক্ষীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। দ্বিপক্ষীয়র মধ্যে বেশি ঋণ দেয় জাপান।