‘মজুতদারদের কারসাজিতে নষ্ট হচ্ছে পাটের ভবিষ্যৎ’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:০৯ এএম, ৯ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৫৯ এএম, ১১ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২৪
কাঁচাপাটের বাজারে চলছে নৈরাজ্য। অবৈধ মজুতের কারণে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি পাটকলগুলো। আপাতত ভালো দাম পেলেও কাঁচাপাটের বাজার নিয়ে যে ‘জুয়া’ শুরু হয়েছে তাতে পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকরাও। এখন বেশি দামে পাট কেনা হলেও পরে পাটপণ্যের প্রতি আগ্রহ হারাবেন দেশি-বিদেশি ক্রেতারা। তখন বাজার দখল করবে সিনথেটিক পণ্য। ফলে পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার হাতছাড়া হবে বাংলাদেশের। তখন ক্ষতি শুধু পাটকল মালিককে নয়, বয়ে বেড়াতে হবে কৃষককেও। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
কৃষকরা জানিয়েছেন, গত দুবছর ধরে তারা পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন। কিন্তু এটি স্থায়ী নয়, স্বাভাবিকও নয়। একদিকে কাঁচাপাট রফতানি, অপরদিকে মজুতদারদের কারসাজিতে নষ্ট হচ্ছে পাটের ভবিষ্যৎ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ক্রেতারা এক সময় আগ্রহ হারাবে। তখন বাজার না পেয়ে অতীতের মতো কৃষক পাটে আগুন দিলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ সালে মোট পাট উৎপাদন হয় ১৩ দশমিক ৭৪ এবং ১৬ দশমিক ৬৭ লাখ টন। সে সময়ে চালু ছিল বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো। বিজেএমসির ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে কৃষকের কাছ থেকে বিজেএমসি পাট কিনেছিল ১ দশমিক ১৪ লক্ষ টন (২০১৫-১৬) যা ২০১৫-১৬-এর মোট উৎপাদনের ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালে এ পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৭ লাখ টন।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার পর এ চিত্র বদলে গেছে। দেশে উৎপাদিত পাটের বড় ক্রেতা হওয়ার কথা বেসরকারি পাটকলগুলো। কিন্তু অবৈধ মজুতের কারণে সেটাও হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুটমিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারিক খান জানিয়েছেন, চাহিদানুযায়ী কাঁচাপাট পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে রফতানি চলছে। অন্যদিকে অবৈধ মজুত গড়ছেন অসাধুরা। যা পাওয়া যাচ্ছে সেটারও দাম বেশি। পাটপণ্যের খরচ বাড়ছে। সেটার দামও বাড়াতে হচ্ছে। এতে বিদেশি ক্রেতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে সব পাটকলই বন্ধ হয়ে যাবে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের বার্ষিক পাটের উৎপাদন ৮৪ থেকে ৯০ লাখ বেল। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বলছে বাংলাদেশে বার্ষিক পাটের চাহিদা ৭০ লাখ বেল। কাজেই বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ বেল পাট রফতানি করলে অভ্যন্তরীণ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে আবদুল বারিক খান বললেন, এ তথ্য সঠিক নয়। দেশে পাটকল ২৫৯টি। এগুলোর বার্ষিক চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ লাখ বেল কাঁচাপাট। এর বাইরে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও রয়েছে ১০ থেকে ১৫ লাখ বেল পাটের। বছরে কাঁচাপাট রফতানির পরিমাণও ৭ থেকে ১০ লাখ বেল। কিন্তু উৎপাদন তথ্য সঠিক নয়। এমন অনুমাননির্ভর তথ্যের কারণে বাজারে সংকট দেখা দেয়। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, সম্প্রতি পাটের দাম বেড়েছে চাহিদার কারণে। কোনও কারণে চাহিদা কমে গেলে কিন্তু পাটের দাম কৃষকরা পাবেন না। তখন পাটকল বন্ধ থাকলে উৎপাদিত পাট কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, বাজারে যদি পাটের বিকল্প পণ্য পাওয়া যায় এবং সেগুলোর দাম যদি পাটপণ্যের চেয়ে কম হয়, তবে পাটপণ্যের চাহিদা থাকবে না। পণ্যের চাহিদা কমলে পাটের চাহিদাও কমবে। তখনও বিপাকে পড়বেন পাটচাষীরা। এমনটি আমাদের কারোরই কাম্য নয়। তাই আগে থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ সমস্যার মূলে আছে কৃষক ও মিল মালিকদের মাঝে তৈরি হওয়া মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। এরা পাট রফতানিকারকদের কাছে পাট দেয়। আবার মিল মালিকদের কাছে পাট পাঠাতে বাধাও দেয়। এরাই মজুত করে মূলত সংকট বাড়াচ্ছে। কৃষকরাও বাধ্য হয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে পাট বিক্রি করে। এ বিষয়ে পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী জানিয়েছেন, পাট মজুতের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। এই আইন ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।