বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে অন্য চক্রও জড়িত, তারা কারা?
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩:০২ এএম, ১৪ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:১২ এএম, ২২ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২৪
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির জীবনে বেদনাঘন এক দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে বাছাই করে দেশের বরেণ্য সন্তানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, গবেষক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার মেধাবীরা। কাউকে বাসা থেকে, কাউকে কর্মস্থল থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পর তাদের নিকট আত্মীয়রা মিরপুর, রায়েরবাজার ইটখোলা ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে গিয়ে খুঁজে পান তাদের স্বজনদের হাত-পা-চোখ বাঁধা মৃতদেহ। এরপরই উন্মোচিত হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। বেদনা ও বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্ববিবেক।
তবে শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড চলে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাস ধরেই। হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যা শুরু করে তার প্রথম শিকার হন বুদ্ধিজীবীরাই। ওই রাতে ঘাতকরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ১৪ ডিসেম্বর। তাই জাতি ফি বছর বিজয় উৎসবের আগে এই দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করে। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। তবে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪)-এ রয়েছে ২৩২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম। যদিও বাংলা একাডেমির তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথা ওই গ্রন্থেই স্বীকার করা হয়েছে। আসলে দরকার হচ্ছে- যারা দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছেন তাদের জাতির সামনে তুলে আনা। প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার প্রাইমারী কিংবা হাইস্কুলের যেসব শিক্ষক তরুণদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন, তাদের অবদানকেও ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং তৃণমূল পর্যায়ে স্বাধীনতার
সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাই ছিল বেশি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাদেরকে শনাক্ত করে জাতির সামনে উপস্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেই। বুদ্ধিজীবীদের বলা হয়ে থাকে জাতির মস্তিষ্ক ও বিবেক। কোনো জাতিকে পঙ্গু করে দিতে হলে তার বুদ্ধিজীবীদের সর্বপ্রথম ধ্বংস করে দিতে হয়। সন্দেহ নেই, ঘাতকরা সেদিন এই কুচিন্তা থেকেই আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ওপর আঘাত হেনেছিল। ১৯৭১ সালে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল তারা বেঁচে থাকলে চিন্তা-মেধা-জ্ঞানে জাতিকে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী বা সমৃদ্ধ করে তুলতে পারতেন। তাদের নৃশংস হত্যাকান্ড জাতিকে সূচনালগ্নেই দুর্বল করে দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের ওপর উপযুক্ত গবেষণা হলে অনেক অজানা তথ্যই বেরিয়ে আসতে পারে। দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পরও বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আজও দেশের মানুষের কাছে রহস্য হয়ে আছে। কয়েক বছর আগে সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যাও প্রশ্ন তোলেন তার পিতার হত্যাকান্ড নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন আছে, শুধু হানাদার বাহিনী নয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সঙ্গে অন্য চক্রও জড়িত। চিহ্নিত করার বিষয়, তারা কারা?
আমরা ১৯৭১ সালে যে বুদ্ধিজীবীদের হারিয়েছি তাদের শূন্যতা কোনোদিনও পূরণ হবে না। বর্তমানে দেশে যে গণতন্ত্র শূন্যতা, জাতীয় জীবনের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে বিতর্ক, জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা তার বড় কারণ দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রের বিশাল শূন্যতা। আজকের বুদ্ধিজীবীরা সে শূন্যতা অনেকটাই দূর করতে পারতেন যদি তারা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীস্বার্থে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-বিভেদ-রেষারেষিতে বিভক্ত না হয়ে পড়তেন। ফলে আজকের বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য হচ্ছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া। তারা ছিলেন সংকীর্ণতা, লোভ-লালসা ও হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু তা দেশে নেই। গণতন্ত্র ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া কোনোদিনই সম্ভব নয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা এই দেশ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রথমেই দরকার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশ ও জাতির স্বার্থ অক্ষুণ্ন্ন রাখা অসম্ভব। বর্তমানে দেশ ও জাতির কাঁধে একদলীয় ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসন চেপে বসেছে। এরফলে জনগণের যেমন বাক্স্বাধীনতা নেই, তেমনি সংবাদমাধ্যমও পারছে না অনেক সত্য উচ্চারণ করতে। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় বিভিন্ন বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে দমন করা হচ্ছে ভিন্নমত। গণতন্ত্রের প্রশ্নে পরিস্থিতি ইংরেজ-পাকিস্তান আমলকেও যেন হার মানিয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী জনগণের সীমাহীন ত্যাগ এবং অসংখ্য বরেণ্য সন্তানের প্রাণদান নিশ্চয়ই এমন পরিস্থিতি দেখার জন্য নয়। সঙ্গত কারণেই আজ দরকার রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে প্রথমে গণতন্ত্র উদ্ধার। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে পারলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। পরিশেষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবার-পরিজন বা উত্তরসূরিদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা।