বায়ুদূষণ কমানোর প্রকল্পের ৮০০ কোটি টাকা লুটপাট
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:৪২ এএম, ১২ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৩:০২ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বায়ুদূষণ কমানো প্রকল্পের ৮০০ কোটি টাকার পুরোটা খরচ হলেও সর্বোচ্চ বায়ুদূষণে ভুগছে ঢাকা। বায়ুদূষণের তালিকায় সপ্তাহজুড়ে শীর্ষে অবস্থান করেছে ঢাকা। বলা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ হয়েছে গত এক সপ্তাহে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত উদ্যোগ না নিলে আরও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, দূষণরোধে কাজ চলছে। কাজ ত্বরান্বিত করতে নেয়া হয়েছে বেশকিছু পদক্ষেপ।
আজ শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী বায়ুদূষণের মানমাত্রায় তৃতীয় স্থানে আছে ঢাকা। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১টায় মানমাত্রা ছিল ১৯০। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মানমাত্রাও অস্বাস্থ্যকর।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকার বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে ৮০২ কোটি টাকা। কিন্তু এই টাকার ৫০ ভাগ ব্যয় করা হয়েছে নন-মেটেরিয়ালস খাতে। অর্থের ২৫ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও অভিজ্ঞতার নামে বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় হয়েছে।
২০০৯ সালে গ্রহণ করা প্রকল্পের মেয়াদ প্রথমে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ধরা হলেও পরে বাড়িয়ে করা হয় জুন ২০১৯ পর্যন্ত। এরই মধ্যে পুরো টাকাই খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পরিবেশ অধিদফতর ও ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
প্রকল্পটির আওতায় রাজধানীর বাতাসের মান খতিয়ে দেখা হয়। এ জন্য ঢাকায় চারটি, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে একটি করে মোট ১১টি নির্মল বায়ু পরীক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়। এসব কেন্দ্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে বাতাসকে ভালো, মধ্যম, অস্বাস্থ্যকর, খুব অস্বাস্থ্যকর, অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এই মানে চিহ্নিত করা হয়। কেন্দ্রগুলোতে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, শীতকালে ১১টি কেন্দ্রে যে মানের বাতাস পাওয়া যাচ্ছে তার অবস্থা খুবই খারাপ।
কেইস প্রকল্পের মোট ব্যয় নিয়ে মন্ত্রণালয়টির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ২৫ ভাগ মেশিনারিজ খাতে ব্যয় করা হয়েছে। আর বাকি ৭৫ ভাগ ব্যয় হয়েছে অন্যান্য খাতে। অন্যান্য খাতের ৭৫ ভাগের মধ্যে ২৬ ভাগ ব্যয় হয়েছে পরিবেশ অধিদফতরের নতুন ভবন নির্মাণে।
গত ১৮ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির ৮ম সভায় কেইস প্রকল্পের পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. এস এম মঞ্জুরুল হান্নান খান জানান, প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ছিল ৮০২ কোটি টাকা। কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে সেই হিসাব দিতে গিয়ে তিনি জানান, মেশিনারিজ খাতে মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৭৫ শতাংশ। এই ব্যয়ে পরিবেশ উন্নয়নে সরাসরি সুফল পাওয়া যাবে না বলে স্বীকার করেছেন খোদ প্রকল্প গ্রহণকারী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী। বৈঠকে কমিটির সভাপতি জানতে চান, এই ব্যয় দেশের প্রেক্ষাপটে স্ট্যান্ডার্ড কিনা? এর কোনো উত্তর মেলেনি।
প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ১৮২ কোটি টাকাই দেখানো হয়েছে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ। আর মিডিয়া ক্যাম্পেইনে গেছে ৩৪ কোটি টাকা। বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৩ কোটি টাকা, মেলা বাবদ খরচ ১০ লাখ টাকা, কালচারাল প্রোগ্রামে গেছে ৯ লাখ, কানসালটেন্সিতে গেছে ৩৩ কোটি আর কর্মকর্তাদের কাপড় ধোয়ায় গেছে ১ লাখ।
কেইস প্রকল্পের মোট বরাদ্দ থেকে গত ১০ বছরে ৩১টি নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই এরই মধ্যে ৯টি গাড়ি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মোট গাড়ির মধ্যে ১৪টি ব্যবহার করছে দুই সিটি করপোরেশন।
সংসদীয় কমিটিতে দেয়া পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ প্রকল্পের ৮০২ কোটি টাকার মধ্যে ৪৬০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) অংশে। এ টাকায় ৮৩ দশমিক ৯১ কিলোমিটার রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাতের উন্নয়ন; ২৩টি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ; ১৮ কিলোমিটার মিডিয়ান-ফুটপাতে গার্ড রেইল স্থাপন; ২০টি যাত্রী ছাউনি ও রোড মার্কিং, জেব্রা ক্রসিং, রোড সাইনের কাজ; ৯৯টি রিমোট কন্ট্রোল ট্রাফিক সিগন্যাল; ডিএসসিসির হাজারীবাগে দোতলা ওয়্যারহাউস-কাম অফিস ভবন নির্মাণ; ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে ২৫ ধরনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় যেসব কাজ করা হয়েছে তা কোনোভাবেই বায়ুর মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিরা রাখতে পারে না বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে বায়ুর মান উন্নয়নের জন্য। কিন্তু আমরা দেখলাম এটা দিকে ফুটওভার ব্রিজ ও ট্রাফিক সিগন্যাল করা হয়েছে। এটা তো পরিবেশের কাজ নয়। এটা করবে সিটি করপোরেশন।
বায়ুদূষণ কমানো কেইস প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলেও ঢাকায় বায়ুদূষণ আরও বেড়েছে বলে মনে করছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘কেইস প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বায়ুর মান উন্নত করা বা দূষণ কমানো। কিন্তু আমরা কতটুকু কমালাম? এই সময়ে দূষণ তো বেড়ে গেছে, কমেনি।’
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি পুনর্মূল্যায়নের জন্য আমরা এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কাছে পাঠিয়েছি। এ থেকে আমরা একটা শিক্ষা নিতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
কমিটির সদস্য ও কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, আসলে আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি প্রকল্পটি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ কমানোর জন্য গ্রহণ করা হলেও এখন আরও বেড়েছে। যে কারণে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি এটা সত্য।
কমিটির সদস্য ও বগুড়া-৭ আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবুল সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলেন, যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে তা ডাইভার্ট হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে। বায়ুদূষণ রোধে করণীয় তেমন কিছুই হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সেলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান বলেন, বায়ুদূষণের চরম শিকার ঢাকা। কেইস প্রকল্প সেই দূষণ উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রেখেছে তা খতিয়ে দেখলে পরবর্তীতে বায়ুদূষণ কার্যক্রমে গৃহীত কার্যক্রমের জন্য শিক্ষা হতে পারে।
পরিবেশ গবেষক আতিক আহসানের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে বছরে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু অস্বাস্থ্যকর থেকে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ছিল। ২০১৫ সালে তা বেড়ে ১৭৩ দিন, ২০১৬ সালে ১২৯ দিন, ২০১৭ সালে ১৮৫ দিন ও ২০১৮ সালে ১৯৭ দিন ছিল। পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ ক্রমেই বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচকে (একিউআই) গত এক বছরের হিসাবে দেখানো হয়, ঢাকায় ২০১৯ সালে গড়ে বায়ুদূষণের সূচক ছিল ৮৩ দশমিক ৩। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ছিল গড়ে ১৮১ দশমিক ৮, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪৫ দশমিক ৭, মার্চে ১০৭ দশমিক ৪, এপ্রিলে ৭০ দশমিক ২, মে মাসে ৫২ দশমিক ২, জুনে ৩৫ দশমিক ৯, জুলাইতে ৩৮ দশমিক ২, আগস্টে ৩১ দশমিক ৩, সেপ্টেম্বরে ৩৭ দশমিক ৭, অক্টোবরে ৬৪ দশমিক ৬, নভেম্বরে ৯৪ দশমিক ২ এবং ডিসেম্বরে সূচক ছিল ১৪৬ দশমিক ৩। এর আগে ২০১৮ সালের গড় ছিল ৯৭ দশমিক ১ এবং ২০১৭ সালের গড় সূচক ছিল ৭৯ দশমিক ৭।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ পরিবহন। পরিবহন খাতে ২০১৫ সালের তুলনায় ১৫ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও কীভাবে এই হার কমানো হবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করা হয়নি। নাসার তথ্যমতে, গত ১০ বছরে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে ইটভাটার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়াও দায়ী। তবে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপে তা কমাতে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন। গত ১০ নভেম্বর তার কাছে প্রশ্নগুলো পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত তিনি উত্তর পাঠাননি। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, বায়ুদূষণ কমাতে আপনার মন্ত্রণালয় থেকে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ (কেইস) প্রকল্পটি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রেখেছে কিনা? এই প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের যথার্থতা নিয়ে সংসদীয় কমিটি আপত্তি জানিয়েছে। কমিটির আপত্তির বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণে ভুগছে ঢাকা : বায়ুদূষণের তালিকায় সপ্তাহজুড়ে শীর্ষে অবস্থান করেছে ঢাকা। বলা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ হয়েছে গত এক সপ্তাহে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত উদ্যোগ না নিলে আরও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, দূষণরোধে কাজ চলছে। কাজ ত্বরান্বিত করতে নেয়া হয়েছে বেশকিছু পদক্ষেপ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) বায়ুদূষণের মানমাত্রায় তৃতীয় স্থানে আছে ঢাকা। গতকাল দুপুর ১টায় মানমাত্রা ছিল ১৯০। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মানমাত্রাও অস্বাস্থ্যকর।
সম্প্রতি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক পর্যবেক্ষণে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরের প্রথম আট দিনে ঢাকায় বায়ুমান সূচকে দূষণ ছিল ১৮১, ২০১৭ সালে ছিল ১৮৯, ২০১৮ সালে ২০৭, ২০১৯ ছিল ১৭৩। এর বিপরীতে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে বায়ুমান সূচক বেড়ে গিয়ে ২৩৭-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৬ দশমিক ৯৯ ভাগ বেশি।
এদিকে চলতি বছরের নভেম্বরে মান সূচকে দূষণের গড় মাত্রা ছিল ১৬৩। নভেম্বরের তুলনায় গড়ে ৪৫ দশমিক ৩৬ ভাগ বায়ুদূষণ বেড়েছে ডিসেম্বরে।
বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যে, গত পাঁচ বছর ধরে ডিসেম্বর মাসে ঢাকার মানুষের একদিনের জন্যও ভালো বায়ু সেবনের সৌভাগ্য হয়নি। অস্বাস্থ্যকর থেকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ুমান অবস্থা বিরাজ করেছে। আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গত পাঁচ বছরের তুলনায় অস্বাস্থ্যকর দিনের সংখ্যা বেড়েছে। এদিকে গত পাঁচ বছরে বায়ুমান সূচকে কখনোই দূষণের মাত্রা দুর্যোগপূর্ণ হয়নি। সেখানে গত ৬ ডিসেম্বর তা দুর্যোগপূর্ণ, অর্থাৎ বায়ুমান সূচকে ৩১০ উঠেছিল।’
বায়ুদূষণের মাত্রা ২০০ ছাড়ালে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। আর ৩০০ ছাড়ালে বলা হয় ‘দুর্যোগপূর্ণ’। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনক্সাইড, মার্কারি ও লেডের মতো ভারী পদার্থ বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এগুলো ফুসফুস ও হৃদরোগ, যকৃতের সমস্যা ও গর্ভবতী মায়েদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশু ও বয়স্কদের জন্যও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।
এদিকে, গত বছর ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের কারণ খুঁজে বের করা এবং বায়ুদূষণ রোধে ও কমাতে নীতিমালা প্রণয়নে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সচিবকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের আদেশ দেন। কোর্টের আদেশে মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রধান করে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধি আছেন।
এদিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তারা বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে ২০টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এসব কারণ চিহ্নিত করে কাজও শুরু হয়েছে। কারণগুলো হচ্ছেÑ ১. ইটভাটা, ২. রাস্তা নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ এবং মেরামত, ৩. সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ এবং মেরামতের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ৪. বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর (যেমন, এক্সপেসওয়ে, মেট্রোরেল) কাজ, ৫. সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, ৬. সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, ৭. রাস্তায় গৃহস্থালী ও পৌর বর্জ্য স্তূপাকারে রাখা এবং বর্জ্য পোড়ানো, ৮. রাস্তার পাশের ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ৯. হাতে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, ১০. বিভিন্ন সড়কের পাশে অনেক অনাবৃত স্থান থেকেও বায়ুদূষণ, ১১. ফুটপাত ও রাস্তার ডিভাইডারের আইল্যান্ডের মাঝখানের ভাঙা বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশের মাটি ও ধুলাবালি, ১২. তীব্র যানজট এবং ফিটনেসবিহীন পরিবহন থেকে ক্ষতিকর ধোয়া নিঃসরণ, ১৩. বিভিন্ন যানবাহনে এ সঙ্গে চাকার সঙ্গে যুক্ত কাদামাটি রাস্তায় ছড়ানো, ১৪. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকার কলোনির ময়লা আবর্জনা পোড়ানো, ১৫. বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল এবং বাণিজ্যিক ভবনের ময়লা আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলে দেয়া, ১৬. ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ প্রবণ এলাকার ধুলাবালি, ১৭. হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, ১৯. অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার করা এবং ২০. সর্বশেষ জনসচেতনতার অভাব।
মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, সম্প্রতি বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি একটি সভা করে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এই সভায় কাজগুলো মনিটরিং জোরদার করতে আলাদা আলাদা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে যে কারণগুলো দায়ী সেগুলোকে আগেই চিহ্নিত করে কাজ করা হচ্ছিল। এখন সেই কারণগুলোকে আলাদা আলাদা করে সাব- কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। কমিটিগুলো তাহলে প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা করে মনিটরিং করতে পারবে। এতে কাজের গতি বাড়বে।’