আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ ‘পরিদর্শনে গিয়ে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে’
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:১১ এএম, ২ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:৪৪ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না‑এই স্লোগান নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের ভূমি ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জমি ও ঘর উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি বছরের জানুয়ারি ও জুন মাসে দুই দফায় আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ঘর উপহার দেয়া হয়েছে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও লাখ খানেক ঘর হস্তান্তরের কথা রয়েছে। আজীবন গৃহহীন এসব দুস্থ, অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপহার পেয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। জমিসহ পাকা ঘরে হাসি-আনন্দ আর উদ্দীপনা নিয়ে বসবাস শুরু করেন তারা। কিন্তু নতুন পাকা ঘরে উঠতে না উঠতেই হাসি-আনন্দ ম্লান হতে শুরু করে। বহু প্রত্যাশিত এই ঘরই এখন তাদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। নতুন ঘরে ওঠার কিছুদিন যেতে না যেতেই দেয়াল ভেঙ্গে পড়া, ফাটল ধরতে শুরু করেছে। নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণের কারণে চলতি বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দি হয়ে পড়ে একশোর অধিক পরিবার। বেশ কিছু এলাকায় নদী তীরে ঘর তৈরির কারণে নদীভাঙন আতঙ্কে রয়েছে তারা। ৩৬টি উপজেলায় হস্তান্তর করা ঘরে ফাটল ধরা, ভেঙ্গে পড়া ও পানিবন্দি হয়ে পড়ার ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এসেছে। এসব ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নজরেও আসে। যার সূত্র ধরে তদন্তেও নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি ও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে আসেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা। পরিদর্শনে গিয়ে কী দেখেছেন‑জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মাহাবুব হোসেন বলেন, আগে যে সমস্যাগুলো গণমাধ্যমে এসেছে পরিদর্শনে গিয়ে আমরা তেমন সমস্যাই পেয়েছি।
দেখা গেছে, কোথাও নিচু জায়গা, কোথাও খালের পাশে, নদীর কিনারায় আশ্রয়ণের ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোই সমস্যা। এক ধরনের অবহেলা পাওয়া গেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, মোটেও অবহেলা ছিল না তাদের। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণে তারা পর্যাপ্ত সময় হাতে পাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, এই ঘরগুলো নির্মাণ করার আগে এলাকার পতিত জমিগুলো আমাদের টার্গেট করতে হয়েছে। দেখা গেছে, ওই জমিগুলো এলাকার কোনও না কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে রয়েছে। এগুলো দখলমুক্ত করে ঘর নির্মাণ করে দেয়া পর্যন্ত আমাদের যে পরিমাণ সময় প্রয়োজন ছিল, আমরা সেই সময় পাইনি। আমাদের ওপরের নির্দেশনা ছিল দ্রুত ঘর নির্মাণ করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ইউএনও বলেন, আমিও কোনও না কোনও মায়ের সন্তান। এই কাজগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে আমরা আনন্দিত। আমি সর্বোচ্চ সততা দিয়ে চেষ্টা করেছি ভালোভাবে ঘরগুলো করতে। তবুও পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় ঘরগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখানে স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা বা শৈথিল্য রয়েছে বলে মনে করি না।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক আরও বলেন, এ ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ-ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেয়া হচ্ছে। মাহাবুব হোসেন বলেন, স্থানীয় প্রশাসন যারা আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের কাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছেন, তাদের ব্যাপারে আমাদের আগের অবস্থানেই আছি। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট বাতিল করা হবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দেয়ার মত সিদ্ধান্তও রয়েছে। যে যেমন কাজ করেছে তার ব্যাপারে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রকল্পের কতগুলো ঘরে এ ধরনের সমস্যা জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, গণমাধ্যমে যে সমস্যাগুলো এসেছে, পরিদর্শনে গিয়ে সে সমস্যাগুলোই আমরা পেয়েছি। এর বাইরে ‘মেজরিটি’ ঘরের অবস্থা ভালো। আমাদের কাছে যে রিপোর্ট এসেছে তাতে এটাই বলা যায়, উল্লেখ করেন তিনি। এখন আর এই ঘরগুলো নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা না। তারপরও আমরা সতর্ক আছি, দেখছি।
মাহাবুব হোসেন বলেন, পরিদর্শনে যাওয়া আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। আমরা যাবই। সবসময়ই মিডিয়াকে জানিয়ে যাওয়া তো হবে না। যাচ্ছি। দেখছি রুটিন ওয়ার্ক করছি। যাতে সর্বোচ্চ ভালো কাজটুকু আমরা পাই।
মাহবুব হোসেন বলেন, আসলে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয় না। আমরা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পারি। এজন্য আপনাদের (মিডিয়া) ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের মাধ্যমে যেগুলো পেয়েছি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে যেগুলো পেয়েছি সেগুলোর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি বলেন, যেমন জামালপুরের সরিষাবাড়ি বিলের মধ্যে যে ঘর করা হয়েছিল। সেটা স্থানান্তর করে অন্য জায়গায় করা হচ্ছে। মূল কথা ক্ষতিগ্রস্ত কেউ হবে না। যাদের ঘর দেয়া হয়েছে, সেসব ঘরে সমস্যা থাকলে পুনরায় ঘর নির্মাণ হবে। ঘর পাওয়া কেউই পথে বসবে না, ঘরেই থাকবেন তারা। আমাদের কারোরই কাজে ঘাটতি নাই। কিছু অবহেলা পাওয়া গেছে। তারপরও অনেক সময় বলে না‑ তবু হায়... । চেষ্টা করছি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই কর্মকর্তা বলেন, এই ঘরগুলো নির্মাণের আগে স্থানীয় প্রশাসনকে আমরা নীতিমালা হস্তান্তর করেছি। নীতিমালা অনুসরণ করা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের এই প্রকল্প নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকতো না।
মাহাবুব হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে অনিয়ম ও অবহেলা যারা দেখিয়েছেন, শৈথিল্য প্রদর্শন করেছেন‑ স্থানীয় ওইসব কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট বাতিল করা হবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দেয়ার মত সিদ্ধান্তও রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, আমাদের প্রকল্পের আওতায় লোকবল কম বলে তদন্তে ডিসিকে প্রধান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় আমরা যে নীতিমালা গ্রহণ করেছি তা অনুসরণ করা হলে অভিযোগ ওঠার কথা নয়।
তিনি বলেন, নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে ঘরের সাইজ কত হবে, কী ধরনের জমিতে ঘর নির্মাণ করা যাবে, ইট, বালি কী পরিমাণ লাগবে, ব্যয়ও নীতিমালায় তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং নীতিমালা অনুসরণ করা হলে ঘরগুলো নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিত না।
তিনি জানান, পরিদর্শনে গিয়ে নয়-ছয় হয়েছে কিনা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান করে, টিআইও সদস্য সচিব, সদস্য সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। প্রকল্প পরিচালক বলেন, ৫ সদস্যের এই কমিটির কাছেই জবাবদিহিতা রয়েছে।