

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের আহবান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:২২ এএম, ২৭ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১১:১৩ এএম, ৩ জুন,শনিবার,২০২৩

অনলাইনে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চালানো দমন-পীড়ন বন্ধ করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
আজ সোমবার ভোরে প্রচারিত সংস্থাটির এক ব্রিফিং-এ এই আহবান জানানো হয়।
নিবর্তনমূলক ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) বাতিল বা আইনটিকে আন্তর্জাতিক মান ও মানবাধিকার আইনের অনুসরণে সংশোধন করারও আহবান জানিয়েছে সংস্থাটি। ‘নো স্পেইস ফর ডিসেন্ট’ শীর্ষক এই ব্রিফিংয়ে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সমালোচনা করায় গুম, বিনাবিচারে আটক ও নির্যাতনের মতো নানান ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ১০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ডিএসএর অধীনে দায়েরকৃত মামলা পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ব্রিফিং-এ বলা হয়, ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ডিএসএর অধীনে দায়ের হওয়া মামলায় অন্ততপক্ষে ৪৩৩ জন কারাবন্দি আছেন; যাদের বেশিরভাগকেই অনলাইনে ভুল এবং আক্রমাণাত্মক তথ্য প্রকাশের অভিযোগে ধরা হয়েছে। যাদেরকে আইনটির নিশানা বানানো হয়েছে তাদের মধ্যে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, গায়ক, এক্টিভিস্ট, উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী এমনকি লেখাপড়া না জানা এক কৃষকও রয়েছেন। ডিএসএর অধীনে একটি মামলায় লেখক মুশতাক আহমেদ বিচারবিহীনভাবে ১০ মাস ধরে কারাগারে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন কারাবন্দী অভিযোগ করেছেন তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি বলেন, ডিএসএর আওতায় কর্তৃপক্ষ যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা থেকেই স্পষ্ট, বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো কিছুর প্রতিবাদ করা বা ভিন্নমত পোষণ কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধরনের মতপ্রকাশে এমন অন্যায্য বিধিনিষেধ আরোপ বাংলাদেশি সমাজের সর্বস্তরে ভয়ের বার্তা ছড়িয়েছে এবং স্বাধীন মিডিয়া ও সুশীল সমাজের কাজের পরিসরকে সংকুচিত করেছে। শুধুমাত্র নিজেদের মতপ্রকাশের অধিকার চর্চার কারণে যেসব মানুষকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ বন্দি করেছে তাদেরকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে। শুধু অনলাইনে একটি মন্তব্য করার কারণে যে কোনো জায়গায় অভিযান চালানো, ডিভাইস ও তাতে থাকা তথ্যাদি জব্দ করা এবং বিনা ওয়ারেন্টে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার মতো নির্বিচার ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রদান করে ডিএসএ। এ ধরনের অনুশীলন ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) দ্বারা সুরক্ষিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন; যেখানে বাংলাদেশও একটি স্বাক্ষরকারী পক্ষ।
সাদ হাম্মাদি বলেন, ডিএসএসহ যাবতীয় আইনকে আইসিসিপিআর এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করতে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে ২০১৮ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ চলাকালীন জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশের যেসব সুপারিশ তারা গ্রহণ করেছিলেন সেগুলোর বিষয়ে আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ব্রিফিং-এ বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রবর্তন করা ডিএসএ সামাজিক মাধ্যম, ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্লাটফর্মে ভিন্নমত দমনের জন্য ক্রমাগতভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে; যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে রয়েছে যাবজ্জীবন। অনলাইনে ভুয়া, আক্রমাণাত্মক, অবমাননাকর ও মানহানিকর বক্তব্য ছড়িয়েছেন এমন অজুহাতে কর্তৃপক্ষ সমালোচনাকারীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। এমনকি আইনটি প্রণয়নের আগে জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত এবং মানবাধিকার রক্ষকদের পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিশেষ দূতরা ডিএসএর খসড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে ডিএসএ সংশোধনের জন্য বাংলাদেশের ইউপিআর-এ জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ গ্রহণ করার পরও সরকার এখন পর্যন্ত নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।
ব্রিফিং এ বলা হয়, মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার কারণে ২০২১ সালের ২৬০ ফেব্রুয়ারি মানবাধিকারকর্মী রুহুল আমিনকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে অযাচিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং জামিনে মুক্তির আগে তাকে ৪৫ দিন কারাবন্দি রাখা হয়। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট করার কারণে ২০২০ সালের মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। পরপর ৬ বার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে জানা যায়।
ব্রিফিং-এ সাদ হাম্মাদি বলেন, কারাগারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা তো দূরের কথা, মুশতাক আহমেদের এক মিনিটও কারাগারে থাকার কথা ছিলো না। ডিএসএর অনেকগুলো ধারায় এমন অনেক কাজকে অপরাধ বানানো হয়েছে যেগুলো আদৌ কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত নয়। ভিন্নমত দমনের জন্য আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের এই অনুশীলন থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি।
মুক্তমতকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা : ব্রিফিং-এ বলা হয়, সমালোচনাকারীদের হয়রানি করতে আইনটির কয়েকটি ধারাকে কর্তৃপক্ষ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এমন উদ্বেগজনক নমুনা খুঁজে পেয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এসব ধারার মধ্যে রয়েছে ২৫ (বানোয়াট, আক্রমাণাত্মক এবং হুমকি সৃষ্টিকারী তথ্যের প্রচার, প্রকাশ প্রভৃতি), ২৯ (মানহানিকর তথ্যের প্রচার, প্রকাশ প্রভৃতি) এবং ৩১ (আইনশৃঙ্খলায় বিঘœ ঘটানোর শাস্তি, প্রভৃতি) ধারা। ডিএসএর আওতায় দায়েরকৃত মামলাসহ অন্যান্য সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত মামলার বিচারের দায়িত্বে থাকা ঢাকার সাইবার ট্রাইবুনাল ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৬ মে পর্যন্ত মোট ১৯৯টি মামলা নথিভুক্ত করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেখেছে এসব মামলার মধ্যে ১৩৪টিতে ডিএসএর কোনো এক বা একাধিক ধারা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ (১৩৪ এর মধ্যে ১০৭টি) মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ডিএসএর ২৫ এবং ২৯ উভয় ধারায়। এতে দেখা যায়, ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের বিরুদ্ধে ডিএসএর ৩টি ধারায়ই মামলা হয়েছে। অন্য ৩ জনের বিরুদ্ধে হয়েছে ২৫ এবং ৩১ উভয় ধারায়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ যেভাবে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাতে মারাত্মক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় এবং এর মাধ্যমে আইনটি ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মানহানিকে ফৌজদারি আইনের বদলে দেওয়ানি আইনে বিচারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছে।
ডিএসএর যথেচ্ছো অপব্যবহার : ব্রিফিংয়ে উল্লিখিত ১০ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধেই মামলা করেছেন আইনপ্রণেতা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। এমদাদুল হক মিলন পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট এবং ঠিকাদার।
তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের একজন স্থানীয় নেতা ২০২০ সালের ৩ মার্চ তাকে ডিএসএর আওতায় আটক করান। মিলন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। এমদাদুল হক মিলন অভিযোগ করেন, উক্ত রাজনীতিক তাকে আটক করান যেন মিলন সরকারের একটি কাজের জন্য ঠিকাদারির প্রস্তাবপত্র দাখিল করতে না পারেন। পরবর্তীতে ওই কাজের ঠিকাদারি পান ওই নেতার মেয়ের জামাই। অবশেষে ২৩ দিন পর এমদাদুল হক মিলন জামিনে মুক্তি পান। আইন প্রয়োগকারী একজন কর্মকর্তা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানান, সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা দমন করা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন স্পষ্ট করে বলে যে, সরকারি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা কখনো শাস্তিযোগ্য হতে পারে না। এই সময়কালে (১ জানুয়ারি থেকে ৬ মে ২০২১) ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল পর্যাপ্ত আইনি ভিত্তি ও প্রমাণাদি না থাকায় প্রায় ৫০ শতাংশ (১৯৯-এর মধ্যে ৯৭টি) মামলা খারিজ করে দেয়। তারপরেও এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে লঘু করে না কারণ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগেই মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়, এমনকি অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে বন্দিদশায় কাটাতে হয়।
ব্রিফিং-এ সাদ হাম্মাদি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে দায়েরকৃত মামলা খারিজের পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশের ক্ষমতাধর লোকেরা কিভাবে ভিন্নমত দমনের জন্য এই আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। ইউপিআর-এ জাতিসংঘের যেসকল সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, ডিএসএর আওতায় লঙ্ঘিত মানবাধিকারের জন্যও তাদের উদ্বেগ জারি থাকতে হবে। একইসাথে ভিন্নমত যাতে আর দমনের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে তাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করতে হবে।