আদালতের বাইরে মীমাংসা, শাস্তি হয় না মানব পাচারকারীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৪০ এএম, ২৫ জুলাই,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৪২ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
ভালো কাজ দেয়ার কথা বলে বহু বেকার তরুণ-তরুণীকে বিদেশে পাঠাচ্ছে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। তবে নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখা তরুণরা হচ্ছেন প্রতারণার শিকার। অনেকে বেঁচে দেশে ফিরতে পারলেও অনেকে হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য। ফেরত আসা ব্যক্তিরা পাচারের কাজে জড়িত দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হয় না। মামলার অনেক বাদী আদালতের বাইরে মীমাংসা করে ফেলায় গ্রেফতার হলেও শেষ পর্যন্ত ছুটে যায় পাচার চক্রের সদস্যরা। আর এতে করে লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। প্রতারক চক্রের নিয়মিত শিকার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণরা।
জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের ১৭ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছরে মানবপাচারে রাজশাহীসহ তিন জেলায় ৪৪টি মামলা হয়। এরমধ্যে ১৮টি মামলা আদালতের বাইরে মীমাংসা হয়েছে। আর গত পাঁচ বছরে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ৬৭০ জন পাচার হওয়ার পরে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৫১২ জন ও ১৫৮ জন নারী। মানবপাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাজশাহীর সাবেক পিপি (দায়িত্বপ্রাপ্ত) আঞ্জুমান আরা খাতুন লিপি বলেন, এই সমস্ত মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে ছিল। এই ট্রাইব্যুনালে অনেক মামলা, তাই দেরি হতো। এখন পৃথক ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। এতে কমেছে মামলার জট।
রাজশাহী আদালতে আসা ৫০টি মামলার সবগুলো পর্যবেক্ষণে রয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহী নগরীর মতিহার থানার খড়খড়ি এলাকা থেকে র্যাব-৫ রাজশাহীর মোল্লাপাড়া ক্যাম্পের একটি দল তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নিশুপাড়ার আবু তাহের ওরফে বাদশা বিন তাহের (৩০), সোন্ধাবাড়ির জিয়াউর রহমান (৩৫) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার খাল্লা এলাকার বিল্লাল হোসেন পলাশ (৩৬)। এদের মধ্যে আবু তাহের নিজেকে বিডি ফিড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিল্লাল হোসেন পলাশ জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেন। র্যাবের দাবি, তারা আন্তঃদেশীয় প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। লোকজনকে ব্যবসা, চাকরি ও বিদেশে চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করতো তারা। অভিযানে ল্যাপটপ-পেনড্রাইভ ছাড়াও জাল সিল, বিডি ফিড প্রোডাক্ট ক্যাটালগ এবং ফাঁকা চেক উদ্ধার করা হয়েছে। এই ঘটনায় প্রতারণার শিকার আল-আমিন বাদী হয়ে নগরীর মতিহার থানায় প্রতারণা ও মানব পাচার আইনে মামলা দায়ের করেছেন।
র্যাব জানায়, সংঘবদ্ধ চক্রটি বিভিন্ন কোম্পানির নামে ভুয়া অফিস ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার যুবকদের দেশে-বিদেশে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল। চক্রটি ভুয়া অফিস ও ফ্যাক্টরি দেখিয়ে চাকরি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। গ্রেফতাররা নিজেদের বিডি ডিজিটাল ফুড, বিডি ফিড কোম্পানির মালিক ও পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু এই সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেয়া হয়। ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে একটি সূত্র জানায়, বিদেশে চাকরি দেয়ার নামে স্থানীয় পর্যায়ে মানবপাচার চক্র কাজ করছে। একজনকে পাচার করতে পারলে পাচারকারীরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পায়। তবে ঢাকায় যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তারা বেশি টাকা পেয়ে থাকে। পাচারকারীচক্র মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজমিস্ত্রি, ওয়েলডিং মিস্ত্রি, গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে সাড়া মিললে তখন সৌদি আরব, ইরাক, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান ও দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চক্রটি ভিসা দেয়, ট্যুরিস্ট, হজ্ব ও ফ্রি ভিসা। যে ভিসার মেয়াদ মাত্র তিন মাস। কেউ কোনোভাবে পাঁচারচক্রের বাইরে পালিয়ে গিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাস কোথাও কাজ করতে পারে। এরপরে ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পুলিশ তাকে আটক করে। রাজশাহীর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সচেতনের প্রকল্প সমন্বয়কারী মাহমুদ-উন-নবী বলছেন, রাজশাহীতে গত পাঁচ বছরে নারীর থেকে পুরুষরা বেশি পাচারের শিকার হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫-২০২০ সালের (পাঁচ বছর) জানুয়ারি পর্যন্ত ৪২টি মামলা হয়েছে রাজশাহী মহানগর ও জেলার বিভিন্ন থানায়। পাচারের শিকার হয়ে দেশে ফিরে ৩৭টি মামলা করেছেন পুরুষরা ও পাঁচটি মামলা করেছেন নারীরা। এর মধ্যে ১৮টি মামলা আদালতের বাইরে দুই পক্ষ বসে আপস মীমাংসা করেছে। এই ১৮ মামলায় ১৪ জন মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে জেল হাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের পরিবার ভিক্টিমের সঙ্গে দেন-দরবার করে মীমাংসা করে নেয়। এছাড়া বাকি মামলাগুলো চলমান রয়েছে। কোনোটি তদন্ত পর্যায়ে, কোনোটি আবার চার্জশিট পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।