লকডাউনে পণ্যবাহী পরিবহন-সংকটে দিশেহারা কৃষক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৫৮ এএম, ১২ জুলাই,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৪৫ পিএম, ১৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলছে সরকারঘোষিত কঠোর বিধিনেষেধ। সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ রাখাসহ যান চলাচল রয়েছে সীমিত। প্রয়োজনছাড়া বাইরে বের হওয়া মানুষের ঘরে ফেরাতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জরুরি সেবা ও কৃষিপণ্যবাহী পরিবহন রয়েছে বিধিনিষেধের আওতামুক্ত। করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে পরিবহন সেক্টরের বেশিরভাগ মালিক-চালক ও শ্রমিকরা রয়েছেন নিরাপদ দূরত্বে। আবার অনেকে বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে পণ্যবাহী পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে করেছে দ্বিগুণ। এতে করে চাহিদা অনুযায়ী পরিবহন সেবা পাচ্ছেন না কৃষকরা। করোনার অজুহাতে অর্ধেক দামে পাইকাররা সবজি কিনছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করা ফসলের দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জেলার কৃষিনির্ভর চাষিরা। দিন দিন করোনার দানবীয় গ্রাসে শহরে-গ্রামে ভীতি বাড়ছে। লম্বা হচ্ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সারি। এ পরিস্থিতিতে কৃষি পণ্যবাহী পরিবহন-সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বেশি ভাড়ায় পরিবহন সেবা মিললেও শেষ নেই ভোগান্তির। এ কারণে সবজি উৎপাদননির্ভর রংপুরের কৃষকরা এখন দিশেহারা। উত্তর জনপদে বন্যার পূর্বাভাসে মাঠ ভরা সবজি নিয়ে চিন্তিত কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো। কঠোর বিধিনিষেধের গত এক সপ্তাহে শুধু পরিবহন-সংকটের কারণে কয়েক লক্ষাধিক টাকার সবজি নষ্ট হয়েছে মাঠেই।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকাসহ রংপুরের ৮ উপজেলায় শাক-সবজি আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৩৮৫ হেক্টর জমিতে শাক-সবজির আবাদ বেড়েছে। ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের তুলনায় শ্রম, উৎপাদন খরচ ও ঝুঁকি কম হওয়ায় শাক-সবজি আবাদে ঝুঁকছেন জেলার কৃষকরা। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বেগুন, করলা, কাঁকরোল, বরবটি, টমেটো, কপি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পানি কুমড়াসহ নানান সবজি ও শাক স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। এ ক্ষেত্রে কৃষি পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকাপ ভ্যান, কাভার্ডভ্যান ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের ভয়ংকর থাবার প্রভাবে পরিবহন-সংকটে কৃষকরা সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। জেলার সবজি উৎপাদন খ্যাত মিঠাপুকুর উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে শাক-সবজির আবাদ হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা ট্রাকসহ পণ্যবাহী অন্য পরিবহনগুলোর সংকটের কারণে কোথাও ঠিক মতো সবজি পাঠাতে পারছেন না। এমনকি স্থানীয় হাটে-বাজারেও পণ্য সরবরাহ করতে ভ্যান, রিকশা বা অটোরিকশা ছাড়া অন্য কোনো পরিবহন সুবিধা মিলছে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করা ফসলের দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক।
এদিকে মিঠাপুকুরের রানীপুকুর গ্রামের কৃষক ফজলু মিয়া জানান, গাড়ি ভাড়া বেশি। লাভের চেয়ে লোকসানের বোঝা বাড়ছে। এ কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মাল পাঠানো যাচ্ছে না। ট্রাকচালকরা করোনা ঝুঁকি নিয়ে কোথাও ভাড়ায় যেতে চায় না। একই এলাকার অপর চাষী গোলাম রব্বানী বলেন, সবজি চাষ করে এখন দাম পাচ্ছি না। পাইকাররা বলছে, ঢাকা থেকে মানুষজন গ্রামে চলে আসছে। তাই সবজি বেশি দামে কিনলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া লকডাউনের কথা বলে অনেক পাইকার সবজি কিনতে আসছে না। সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর জেলার হাট-বাজারগুলোতে আগের মতো শাক-সবজি কেনাবেচা নেই। নেই বাইরের জেলা ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পাইকাররাও। নিজেরাই দোকান সাজিয়ে বসছেন অনেক কৃষক। তবে ক্রেতার অভাবে কম দামে সবজি বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। রংপুর নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্ট্যান্ডে শত শত ট্রাক পড়ে আছে। কঠোর বিধিনিষেধ ও মামলা-জরিমানার ভয়ে পিকাপ ভ্যান, কাভার্ডভ্যান চলাচলও সীমিত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি সেবাসহ কৃষি পণ্যবাহী পরিবহন চালু থাকলেও শুরু থেকেই বেশির ভাগ ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ রেখেছেন পরিবহন মালিক, চালক ও শ্রমিকেরা। আবার কোথাও পরিবহন সেবা মিললেও অন্য সময়ের চেয়ে দিতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। তবে ট্রাকের চালকরা বেশি ভাড়া নেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। উল্টো তাদের অভিযোগ, বিধিনিষেধের কারণে সড়কে আগের চেয়ে প্রশাসন এখন কঠোর অবস্থানে। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে জেরা করা হচ্ছে। কাগজপত্রের একটু ভুল পেলেই মামলা ঠুকিয়ে দিচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।
রংপুর জেলা ট্রাক-ট্যাংকলরি-কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মানিক বলেন, করোনার কারণে আমরা সবাই বিপাকে আছি। পরিবহন মালিকদেরকেও ব্যাংকের লোন পরিশোধে লেনদেন করতে হচ্ছে। তাদের টাকার প্রয়োজন। কিন্তু অনেক ড্রাইভার-হেলপার ও শ্রমিক করোনায় ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে আসছে না। এ জন্য অনেক গাড়ির চাকা ঘুরছে না। করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখীর কারণে বিধিনিষে দিয়েছে সরকার। এতে করে পরিবহন চলাচল সীমিত হয়েছে। তবে কৃষি পণ্যবাহী পরিবহনের চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। অপরদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সবজির দাম চড়া রয়েছে । তাই কৃষি বিভাগ বিপণন অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে রংপুরের উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্বিঘেœ পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।