বর্ষা মৌসুমে ভাসানচরে আতঙ্কে রোহিঙ্গারা : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:৪৭ এএম, ৯ জুন,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৩১ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বর্ষা মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের বুকে ভাসানচরে আতঙ্কে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তাদের নিরাপত্তা ও ভাসানচরে মুক্তভাবে চলাচলের জন্য আহ্বান জানানো উচিত জাতিসংঘ ও দাতা দেশগুলোর। এমন আহ্বান জানিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এতে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, জীবন-জীবিকা অথবা সুরক্ষার অভাব রয়েছে ওই দ্বীপে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। আসন্ন বর্ষা মৌসুম ও অন্যান্য বিপদের কথা মাথায় রেখে তাদের নিরাপত্তা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং বসবাসযোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য জাতিসংঘ ও দাতা দেশগুলোর সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে আহ্বান জানানো উচিত। ৫৮ পৃষ্ঠার ‘অ্যান আইল্যান্ড জেল ইন দ্য মিডল অব দ্য সি’ : বাংলাদেশজ রিলোকেশন অব রোহিঙ্গা রিফিউজিস টু ভাসানচর’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ওইসব শরণার্থীর বেশির ভাগকেই তাদের পূর্ণাঙ্গ এবং অবহিতকরণ বিষয়ক সম্মতি ছাড়াই স্থানান্তর করেছে। এর ফলে মূল ভূখন্ডে তাদের ফেরত আসা বন্ধ করা হয়েছে। সরকার যখন বলছে যে, তারা বঙ্গোপসাগরের বুকে পলিমাটি জমে গড়ে ওঠা ওই চরে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করতে চায়, তখন মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা তীব্র শক্তিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় এবং জোয়ারের ফলে তাদের সুরক্ষা নিয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ওই দ্বীপে স্থানান্তর হওয়া শরণার্থীরা এরই মধ্যে অনেক অভিযোগ তুলেছেন। তার মধ্যে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা অন্যতম। এ ছাড়া চলাচলে বিধিনিষেধ আছে। আছে খাদ্য স্বল্পতা। জীবনজীবিকা নির্বাহের কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ আছে।
শরণার্থী এবং অভিবাসীদের অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেন, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। কিন্তু জোর করে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে এসব মানুষকে পাঠানোতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সমস্যা। এর প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করা উচিত আন্তর্জাতিক দাতাদের। ২০২০ সালের মে মাস থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৬৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এর মধ্যে ১১৭ জন ভাসানচরের এবং ৫০ জন কক্সবাজারের। কক্সবাজারের ওইসব শরণার্থীর মধ্যে ৩০ জন আবার পরে ভাসানচরে স্থানান্তর হয়েছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো মিয়ানমারের। সেখানে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতি নিধনের উদ্দেশে সেনাবাহিনী নৃশংস নির্যাতন শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ। এর ফলে কমপক্ষে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এর আগেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিন লাখ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা। বিশ্বজুড়ে নিন্দা জানানোর পরও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। এমনকি তারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে এবং স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পক্ষান্তরে পলায়নরত রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করেছে বাংলাদেশ। কর্তৃপক্ষ সত্যিকারভাবে আশ্রয় শিবিরের পরিবেশ অতিথিপরায়ণ করতে পারেনি। এর ফলে তাদেরকে ভাসানচরে পুনর্বাসনের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশ্রয় শিবিরে এক বছর ধরে ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তাদের শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অধিকার দেয়া হয়নি। রোহিঙ্গাদের চলাচল ও জরুরি সেবার সুবিধা সীমাবদ্ধ করতে নির্মাণ করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার, জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ আছে। ২০২০ সালের মে মাসে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা কমপক্ষে ৩০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রথম ভাসানচরে নেয় বাংলাদেশ। যদিও সরকার প্রথমে বলেছিল যে, আশ্রয় শিবিরে করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে এসব মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে ভাসানচরে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওইসব রোহিঙ্গা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে পারেননি। ডিসেম্বরে কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির থেকে কয়েক হাজার শরণার্থীকে ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করে। তাদেরকে অভাব, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। জাতিসংঘের ১৮ সদস্যের একটি টিম ১৭ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ওই দ্বীপ পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু এসব শরণার্থীর জন্য মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য জাতিসংঘকে চাপ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
শরণার্থীরা বলেছেন, জাতিসংঘের ওই প্রতিনিধিদের সফরের সময় তাদেরকে শুধু তখনই কথা বলতে দেয়া হয়েছে, যখন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, ভাসানচরে কোনো সমস্যা নেই এমনটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে সরকার। এ বছর ৩১ মে ভাসানচর সফররত জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সমবেত হন কয়েক হাজার শরণার্থী এবং তারা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। এ সময় শরণার্থীরা তাদের নাজুক পরিস্থিতির জন্য প্রতিবাদ করছিলেন। তাদের অনেকে বলেছেন, ওই দ্বীপে আর থাকতে চান না। আগেই বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদেরকে অভিযোগ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিল বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা। ওইদিন রোহিঙ্গারা সরকারি নির্দেশ অমান্য করলে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এ সময় নারী ও শিশুসহ বেশকিছু রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন।
হিউম্যান রাইট ওয়াচ বলেছে, ভাসানচরে ভবিষ্যতে মানবিক কোনো অপারেশন নিয়ে জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করা উচিত। রোহিঙ্গাদের মঙ্গল, নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা উন্নত করার বিষয়ে জাতিসংঘ যেসব সুপারিশ করেছে তা অনুসরণ করা উচিত বাংলাদেশের। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে যে, তারা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের অবস্থানস্থলে পর্যাপ্ত খাদ্য, পয়ঃনিষ্কাশন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে তাদের সম্মতিতে। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশ সরকারের এ বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ৫৩ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা বলেছেন, ক্যাম্পের প্রশাসক তাকে হুমকি দেয়ার পর তিনি আত্মগোপন করেছিলেন, যাতে তাকে ওই চরে নেয়া না হয়।
তিনি বলেন, যদি আমি মারাও যাই, তবু তারা আমার মৃতদেহ ওই চরে নেবেই। সেখানে আমি যেতে চাই না। অন্যরা বলেছেন, তারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে স্বেচ্ছায় গিয়েছেন। ভাসানচরে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভিযোগ করেছেন রোহিঙ্গারা। এ বিষয়ে ১৪ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে তারা বলেছেন, তারা অ্যাজমা, ব্যথা, জ্বর, গিঁটে ব্যথা, ডায়াবেটিস, আলসার এবং ম্যালেরিয়াসহ নানা রোগের জন্য চিকিৎসা চেয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে প্যারাসিটামল ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা হয়েছে। ওই ১৪ জনের মধ্যে চারজন পরে মারা গেছেন। এটা সেখানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা ফুটিয়ে তোলে বলে বিশ্বাস করেন তাদের পরিবার। ওই দ্বীপে জরুরি মেডিকেল সেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি কোনো ডাক্তার রেফার করেন এবং দ্বীপের কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন তাহলে একজন শরণার্থীকে বোটে করে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হবে। তারপর দুই ঘণ্টার সড়কপথের যাত্রা শেষে নিকটবর্তী হাসপাতাল। সেখানে জরুরি সেবার ব্যবস্থা আছে। অন্তঃসত্ত্বাদের জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল চিকিৎসার প্রয়োজন। সন্তানের জন্ম দেয়ার সময় এক ব্যক্তির স্ত্রী মারা গেছেন। ওই ব্যক্তি বলেছেন, প্রসব বেদনা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মূল ভূখন্ডের একটি হাসপাতালে পাঠানোর অনুমোদন দিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেতে কেটে গেল দুই ঘণ্টা। এরই মধ্যে মারা গেছেন তার স্ত্রী।
শরণার্থীরা আরো বলেছেন, তাদেরকে শিশুদের শিক্ষার জন্য শিক্ষক, স্কুল এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু একজন সাহায্যকর্মী বলেছেন, ভাসানচরে বসবাস করছে ৮৪৯৫টি শিশু। তাদের শিক্ষা বলতে চারটি এনজিও শিক্ষা দিচ্ছে। তবে সেই সুযোগ পাচ্ছে অনধিক ১৫০০ শিশু। ৩৫ বছর বয়সী মিজান বলেন, তার ৭ ও ৯ বছর বয়সী দুই মেয়ে ভাসানচরে যে শিক্ষা পাচ্ছে, আশ্রয় শিবিরে এর চেয়ে ভাল শিক্ষা পেতো। তার ভাষায়, আমরা এই দ্বীপে অবস্থান করছি ৬ মাস। আমার মেয়েরা তাদের ব্যাগ ও বইসহ সবকিছু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। তারা পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু পড়াশোনা শেখার কোনো কেন্দ্র নেই এখানে। জুনে শুরু হয়েছে বর্ষা মৌসুম। এ সময়ে উচ্চ গতির বাতাস এবং বন্যার ঝুঁকি আছে এই দ্বীপে। দ্বীপের চারপাশে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা তিন মাত্রার একটি ঝড় বা তার চেয়েও ভয়াবহ কোনো ঝড়ের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু সরকার বলেছে, ঘূর্ণিঝড়ের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র আছে। চরের শরণার্থী, বাংলাদেশি নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ও মানবিক কর্মীদের এই মৌসুমে এই চরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে সম্প্রতি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন বন্ধ করেছেন কর্তৃপক্ষ।