রাজশাহী : আইসিইউয়ের জন্য কান্না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১০ এএম, ৮ জুন,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৩১ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তরের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার নিয়ামত আলী (৭০) শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এটা গত ৩১ মে’র ঘটনা। মৃত্যুর পরের দিন, নিয়ামতের পরিবার জানতে পারে, তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে তার পরিবারের আরও সাত সদস্যের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। নিয়ামতের ছেলে ময়েন উদ্দিন বলেন, আমার বাবা দু বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এবার যখন তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলেন, তখনও আমাদের কোনো সন্দেহ হয়নি যে, তার করোনা হতে পারে। এখন আমরা সবাই ঘরবন্দি হয়ে দু সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে আছি। বর্তমানে, রাজশাহীর স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন সীমিত সংখ্যক ভেন্টিলেটর ও উচ্চ-প্রবাহের অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা থাকা শয্যা দিয়ে বাড়তে থাকা রোগী সামলাতে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাড়তে থাকা করোনা পরীক্ষার চাপ। এই পরিস্থিতির মধ্যে কিছু অভিযোগ আসছে যে, সঠিক সময়ে করোনা পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারছে না। অনেকে বলেছেন, পরীক্ষার ফলাফল জানতে দেরি হওয়ায় বা জানতে না পারায় সংক্রমণের আরও বিস্তার ঘটছে। গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রামেক হাসপাতালের কোভিড-১৯ ইউনিটে আরও সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবাই কোভিড-১৯ পজিটিভ।
সকালে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, মারা যাওয়া সাত জনের মধ্যে তিন জনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে, একজনের রাজশাহীতে, একজনের নাটোরে, একজনের নওগাঁয় ও একজনের পাবনায়। ২৪ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত রামেকের কোভিড-১৯ ইউনিটে মোট ১১৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৭১ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন এবং বাকিরাও কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। রবিবার থেকে রাজশাহীর স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ শহরের সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট, হড়গ্রাম বাজার, সিএন্ডবি মোড়, লক্ষ্মীপুর ও তালাইমারি পয়েন্টে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু করেছে। এই পয়েন্টগুলো থেকে মোট ২৯৭টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং এর মধ্যে ২৭ জনের করোনা পজিটিভ আসে। এই হার অনুযায়ী, সিভিল সার্জন মো. কাইয়্যুম তালুকদার বলেন, যারা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছেন তাদের নয় শতাংশ কোভিড-১৯ নিয়েই ঘুরছেন।
রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানি জানান, তিনি দুু সপ্তাহ আগে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে রাজশাহী বিভাগের চারটি জেলায় ‘সম্পূর্ণ লকডাউন’ দেয়ার অনুরোধ করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কর্তৃপক্ষ ২৪ মে থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছে। গতকাল রামেক ল্যাবরেটরিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৪৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নয় জন পজিটিভ বলে জানা যায়। এর অর্থ সংক্রমণের হার ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আম ব্যবসার জন্য রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় রাত্রিকালীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দিনের বেলা নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল রাখা হয়েছে। যদিও এই নিষেধাজ্ঞা মানুষকে ঘরবন্দি করতে পারেনি। মানুষ কাজের সন্ধানে বা আম ব্যবসার কারণে রাস্তায় বের হচ্ছে। অনেকে কাজ ছাড়াই ঘর থেকে বের হচ্ছেন। তবে আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ রয়েছে। নাটোর জেলা প্রশাসন এখনও লকডাউন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে এই জেলার কোভিড-১৯ শনাক্তের হার বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। নওগাঁর নিয়ামত আলীর ছেলে ময়েন উদ্দিন জানান, তার বাবাকে গত ২৯ মে রামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছিলেন। (রামেক হাসপাতালের) ডাক্তাররা আমার বাবাকে আইসিইউতে নেয়ার কথা বললেন। কিন্তু আরও ৩৫ জন তখন একটি আইসিইউ বেডের অপেক্ষায় ছিলেন। তাদের মধ্যে আমার বাবার চেয়ে কম বয়সী ও বেশি গুরুতর রোগীও ছিলেন। আমার বাবার সিরিয়াল আসার অনেক আগেই তিনি মারা যান। আমরা তার লাশ নিয়ামতপুরে এনে দাফন করি, বলেন তিনি। বাবা মারা যাওয়ার পরদিন ১ জুন ময়েন একটি এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারেন তার বাবার করোনা পজিটিভ ছিল।
ময়েন জানান, নমুনা দেয়া হয় ২৯ মে এবং এসএমএস আসতে সময় নেয় চার দিন। পরীক্ষার ফলাফলের এসএমএস যাওয়ার কথা তিন দিনের মধ্যে। ময়েন উদ্দিনদের পরিবারের ১৭ জন করোনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন এবং গত শুক্রবার জানতে পারেন যে, তাদের সাত জন কোভিড-১৯ পজিটিভ।
ময়েন জানান, আক্রান্ত পরিবারের সদস্যরা উপজেলার কানইল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে তাদের নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে আছেন। আমরা সময়মতো জানতে পারলে সতর্ক হতে পারতাম। তবে আমাদের আক্রান্ত সাত জনের কারো কোনো উপসর্গ নেই। রামেক হাসপাতাল পরিচালক জানান, আজ হাসপাতালে মোট ভর্তি ২৩২ করোনা রোগীর মধ্যে ১৮ জন আইসিইউতে রয়েছেন। ৪০ জনেরও বেশি রোগী আইসিইউ শয্যার অপেক্ষা রয়েছেন। হাসপাতালটির আইসিইউগুলোতে মোট ১৮টি ভেন্টিলেটর রয়েছে। যেখানে আরও বেশি ভেন্টিলেটর প্রয়োজন।
হাসপাতাল পরিচালক বলেন, আমরা সরকারের কাছে আরও ভেন্টিলেটর চেয়েছি। যোগাযোগ করা হলে, রামেক অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী জানান, কলেজ বিশেষজ্ঞরা দুটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগারে করোনা পরীক্ষা করছেন। সেখানেও প্রচন্ড চাপ। চার শিফটে কাজ করেও প্রতিদিন ৫০০টির বেশি নমুনা পরীক্ষা বাকি থাকছে। রাজশাহী বিভাগের চার জেলা ছাড়াও আশেপাশের অন্য জেলা থেকেও নমুনা পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে সরকার রাজশাহীতে আরও একটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগারের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। তবে এটি এখনও কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। কারণ মেশিনের একটি অংশ ঢাকা থেকে রাজশাহীতে পৌঁছেনি। পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা স্বাস্থ্য তথ্য অধিদফতরের জেনারেল ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে ফলাফল পাঠান এবং সেখান থেকেই যারা নমুনা দিয়েছেন তাদের জানিয়ে দেয়ার কথা। তিনি বলেন, এসএমএস নিয়ম অনুসারে পাঠানো হয়। কিন্তু অনেকে এসএমএসে অভ্যস্ত নয়।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে সংক্রমিতদের অবহিত করতে এবং তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে ফলাফল পাঠান হয়। কারিতাস বাংলাদেশের এরিয়া ম্যানেজার নিত্ত্য দেব শর্মা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার আডায় তার অফিসে প্রায় ১৪ জনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, তারা সবাই নমুনা দিয়েছেন, কিন্তু কোনও এসএমএস এখনও পাননি। তারা র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টেও পজিটিভ হয়েছেন। নগরীর সামগ্রিক কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য গতকাল রাজশাহীতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবির, ডিআইজি আবদুল বাতেন, সিটি পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে রাজশাহীতে চলমান রাত্রিকালীন নিষেধাজ্ঞা সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরুর পরিবর্তে বিকাল ৫টা থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।