বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানি স্যার পি সি রায়ের ১৬১ তম জন্মদিন আজ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:০৭ পিএম, ২ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:১৬ এএম, ২৮ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানি, রসায়নবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ- সংস্কারক, দানবীর, সমাজ- সেবক, রাজনীতিবীদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবীদ, সমবায় দর্শনের প্রবক্তা, এতগুলো বিশেষণে বিশেষায়িত মানুষটির নাম স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (পি সি রায়)। মহান এই সাধকের ১৬১ তম জন্মবার্ষিকী আজ।
বিজ্ঞানী স্যার পি সি রায় ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ তীরের রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্যার পি সি রায়ের বাবা হরিশ চন্দ্র ও মা ভুবনমোহিনী দেবী।
জমিদার পরিবারের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় ছিলেন। তার পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশায় রোগের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। গ্রামে থাকার এই সময়টা তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই পান তিনি এবং বইপাঠ তার জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করে। ১৮৭৪ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন। এখান থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন। ডিএসসি ডিগ্রি লাভের জন্য কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ভারত বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে সাড়া ফেলে দেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্য নতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান। তার উদ্যোগে তার নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তার গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন। তার এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার সৃষ্টি হয় যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করে বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করেন। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। পিসি রায় ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ সালে বিজ্ঞানী পিসি রায় পিতার নামে আরকেবিকে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে তিনি পি সি কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষের মহিশুর ও বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
এছাড়া মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও নাইট উপাধি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন জীবনাবসান ঘটে চিরকুমার বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। এই বিজ্ঞানী তার জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি মানব কল্যাণে দান করে গেছেন।
স্যার পি সি রায়ের বাড়িটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। বাড়িটি বেশ কয়েকবার দখল হওয়ার পর বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে বিজ্ঞানীর জন্ম ও মৃত্যুদিবসে এখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বাড়িটির সামনেই রয়েছে পাথরে অঙ্কিত পি সি রায়ের ছবি। এর একপাশে রয়েছে একটি পুকুর। মাঝখানে একটি ফাঁকা স্থানকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে পুরো বাড়িটির নকশা। দোতালা মূল ভবনের পাশেই রয়েছে ছোট মন্দির ও একতলা আরও কয়েকটি ভবন। প্রায় ১৭০টি স্তম্ভের উপর বসানো পুরো কমপ্লেক্সটিতে মোট ৪৫টি দরজা ও প্রায় ১৩০টি জানলা রয়েছে। মূল ভবনের ছাদের উপর রয়েছে একটি সিংহমূর্তি। যা মানুষের জন্য দর্শণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবছরের মতো জন্মদিন উপলক্ষে খুলনা জেলা প্রশাসন ও পাইকগাছা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে।