বাংলাদেশকে নিয়ে আল জাজিরার প্রকাশিত প্রতিবেদনের জাতিসংঘের তদন্ত চায় বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩১ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:০৮ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাংলাদেশকে নিয়ে আল জাজিরার সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনের অভিযোগ জাতিসংঘের তদন্ত চায় বিএনপি।
আজ বুধবার বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ দাবি জানান।
তিনি বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় ‘All the Prime Minister’s Men’ শীর্ষক প্রচারিত অনুসন্ধান প্রতিবেদন সম্পর্কে দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর সাথে আপনারাও নিশ্চয়ই অবগত আছেন। ঐ প্রতিবেদনে সরকারপ্রধানের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশে- বিদেশে তথ্যপ্রমাণসহ নানান দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সকল প্রতিবাদ বিবৃতিতে প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযোগসমূহের সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে রাজনৈতিক বুলির আড়ালে অভিযোগসমূহ প্রত্যাখ্যান করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকেও অপরাধ আড়ালের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বিএনপিও সরকারের ঐসকল বক্তবের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছিল।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ এবং তার প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ-বিবৃতিকে জাতিসংঘ আমলে (cognizance) নিয়ে জানিয়েছে যে "The allegations of corruption (are) a serious matter that should be investigated by the relevant authorities." দুর্নীতির অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করার আহবানের পাশাপাশি জাতিসংঘ জানিয়েছে যে, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কর্তৃক আল জাজিরার প্রামাণ্যচিত্রে যে ধরনের অত্যন্ত সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের কথা উঠে এসেছে ওই ধরনের কোনো সরঞ্জাম ব্যবহারের বিষয় জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের সম্পাদিত চুক্তিতে নেই। তাছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের কোনো কন্টিনজেন্টে এ রকম সরঞ্জাম ব্যবহারও করে না। UN Peacekeeping-Intelligence Policy অনুযায়ী কেবলমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় ঐ ধরনের যন্ত্রপাতি জাতিসংঘ ব্যবহার করে থাকে। এবং তাও ‘strictly’ ব্যবহার হয়ে থাকে কেবলমাত্র UN Peacekeeping-Intelligence Policy এর আওতায় জাতিসংঘের Force Commander এর সরাসরি কর্ত্বত্বে। সরকার হাঙ্গেরি থেকে আড়িপাতা যন্ত্রপাতি কেনার কথা ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন একটি দেশ থেকে এসব সরঞ্জামাদি আমদানির ক্ষেত্রে অপকৌশল অবলম্বনের অভিযোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা সরকারি বিবৃতিসমূহে অনুপস্থিত। অথচ বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গুরুতর অভিযোগ।
মোশাররফ হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে ৭টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা যেমন (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, দ্য এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাগেইনস্ট টর্চার, দ্য এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং ইলিয়স জাস্টিস) এক যৌথ বিবৃতিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযোগগুলো নিয়ে জাতিসংঘকে নিজের মতো করে তদন্ত এবং শান্তিরক্ষা মিশনের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি ইউনিট ও ব্যক্তিদের মানবাধিকারের রেকর্ড নতুন করে যাচাই করার আহ্বান জানিয়েছে। নিজ দেশে সংঘটিত কোনো অনিয়ম আড়াল করার জন্য জাতিসংঘকে ব্যবহার না করার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং সামগ্রিক পর্যালোচনার আগ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি বিষয়ক আলোচনা স্থগিত রাখা উচিত বলেও ঐ ৭টি সংগঠন জাতিসংঘকে জানিয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, একদিকে সরকার আল জাজিরার পুরো প্রতিবেদনকেই মিথ্যা ও বানোয়াট বলে নাকচ করে দিয়েছে; অপরদিকে দায়সারাভাবে জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্ত আহবানে অনাপত্তি জানিয়ে বলেছে, ‘তদন্ত হতেই পারে, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। সরকারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করবো। তবে তদন্তের জন্য জাতিসংঘ সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অনুরোধ জানায়নি।’ আবার অন্যদিকে আল জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে তথ্যগত ভুল আছে, সেগুলো আমরা তুলে ধরবো এবং আমরা মামলা করবো। আমরা সেটার জন্য কাজ করছি।’ অর্থাৎ আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই না করেই সরকার প্রতিবেদনটিকে ঢালাও ভাবে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অথচ সঠিক তথ্যের প্রকাশই হচ্ছে ভুল তথ্যের জবাব। আর অপপ্রচার থেকে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের উপায়ও হচ্ছে আসল সত্য তুলে ধরা। কিন্তু সরকার প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু উহ্য রেখে খন্ডিত তথ্য অথবা প্রান্তিক বিষয়ের উপর ভর করে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ প্রকাশ করে চলছে। যদিও তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারের আগে অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল যা তারা উপেক্ষা করেছে।
সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জাতীয় সংকটে অকাতরে কাজ করে যাওয়া দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বদা জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দুর্নীতি বা নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মের কারণে রাষ্ট্রের সংবেদনশীল এই মহান প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আল জাজিরার প্রতিবেদনে প্রচারিত অভিযোগসমূহে উল্লিখিত অনেক বিষয় নিঃসন্দেহে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। দেশে ও দেশের বাইরে একাধিক দেশে এসব অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সংবাদের কারণে উল্লিখিত অভিযোগসমূহ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধে রূপলাভ করেছে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শান্তি মিশনের জন্য হাঙ্গেরি থেকে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি আমদানির কথা ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে কিন্তু জাতিসংঘ পরিষ্কার ভাষায় তা নাকচ করে দিয়েছে। এখন জনমনে প্রশ্ন, অবৈধভাবে আমদানিকৃত ঐসব আড়িপাতা ও নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের সরঞ্জামাদি কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে? জনশ্রুতি আছে যে, এসব সরঞ্জাম বিরোধী জনমতকে দমন করার কাজে ব্যবহার করে নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকারের মতো সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে চলছে সরকার, যা গণতন্ত্র হত্যা তথা সংবিধান লঙ্ঘনজনিত অপরাধের শামিল।
সেনাবিহিনী তথা প্রতিরক্ষা বাহিনী জাতীয় ঐক্যের গর্বিত প্রতীক। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখা দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। গোপনীয়তা লংঘনে আড়িপাতার সিগনাল সরঞ্জামাদি আমদানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নাম ব্যবহারের সরকারি ব্যাখ্যা জাতিসংঘ কর্তৃক বাতিল হওয়ার পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বৃহত্তম অংশীদার হিসেবে ঐ দায়িত্বে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতাই এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে আমরা আশংকা করছি। এরূপ আশংকার মধ্যেই জাতীয় ঐক্যের প্রতীক আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলতে পারে তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, ভবমূর্তি এবং প্রাসঙ্গিকতা।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির এই সিনিয়র সদস্য বলেন, এ চিত্র সুশাসনের অভাবে মানবাধিকার লংঘন তথা দুঃশাসনের এক বিশাল ক্যানভাসের কেবলই ক্ষুদ্র চিত্র, রাষ্ট্রক্ষমতার চরম অপব্যবহার ও মাফিয়া সংস্কৃতির এক অতি ক্ষুদ্রাংশ, রাষ্ট্রযন্ত্রকে কুক্ষিগত করে ক্ষমতার দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার ভয়ানক প্রক্রিয়ার এক অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ (Fraction) এবং লাগামহীন সাগর-সম দুর্নীতির একটি Tip of the iceberg মাত্র। তাই দেশের চলমান এই শাসরুদ্ধকর বাস্তবতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বিএনপি মনে করে ম্যান্ডেটবিহীন এই অবৈধ সরকার বহু আগেই জনগণ কর্তৃক ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েও গায়ের জোরে কেবলমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেই ক্ষমতায় টিকে আছে। ফ্যাসিবাদি কায়দায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, চাঁদাবাজি, লুন্ঠন আর সীমাহীন দুর্নীতির এক অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে গোটা দেশকে। দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এই দুঃশাসনের চিত্র জনসম্মুখে আসছে না। এ প্রেক্ষিতেই আল জাজিরার ঐ প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে সকল মহলকে করে তুলেছে আরও উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত। ৭টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে জাতিসংঘের নিজস্ব পদ্ধতিতে যে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করছে এবং জাতিসংঘকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে আশু তদন্তের আহবান জানাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপি নেতা জহিদ উদ্দিন স্বপন, বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার ।
এই সংবাদ সম্মেলনের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। এতে সিঙ্গাপুর ধেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জামির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩ টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এসময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।