স্মরণ সভায় বক্তারা
আবরার ফাহাদ ছিলেন ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ৭ অক্টোবর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ১০:২৯ এএম, ২৭ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া শহীদ আবরার ফাহাদকে এই শতাব্দীর শহীদ তিতুমীর আখ্যা দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
শহীদ আবরার ফাহাদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ পলাশীর মোড়ে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ আয়োজিত এক স্মরণসভায় এমন মন্তব্য করেন মাহমুদুর রহমান।
মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে আমাদের যে সংগ্রাম চলছে, শহীদ আবরার ফাহাদের শহীদ হওয়ার ঘটনা এই সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট। আমরা শহীদ আবরার ফাহাদকে আগামী শত বছর পরেও স্মরণ করতে চাই যে তিনি একজন অসামান্য সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। আবরার ফাহাদ এই শতাব্দীর শহীদ তিতুমীর।
মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাতটি দাবি জানিয়েছিলাম, যার অন্যতম দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের নাম পরিবর্তন করে শহিদ আবরার ফাহাদ এভিনিউ করা। কারণ শহীদ আবরার ফাহাদ আমাদের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ভারতীয় আগ্রাসনে বিরুদ্ধে আগ্রাসন বিরোধী প্রতীক। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হলেন ফ্যাসিবাদের প্রতীক। ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমি আবারো দাবি জানাচ্ছি, আপনি অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের নাম আবরার ফাহাদ নামে নামকরণ করুন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের চিত্র স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন বুয়েটের ছাত্র মাহমুদুর রহমান বলেন, সেদিন ঢাকার মানুষের যেই আনন্দ আমি দেখেছি তা এখনো আমার চোখে ভাসে। তিনি বলেন, এখন আমাদের একটা বিরাট সুযোগ এসেছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার। আমাদের যে তরুণ সমাজ লড়াই করছে তারা তাদের সংগ্রামের প্রথম রাতে জয়লাভ করেছে। আর তা হল শেখ হাসিনার পতন। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনো জয়লাভ করতে পারেনি। আমাদের জনগণকে সাথে নিয়ে এই আগ্রাসন রুখে দিতে হবে। আমি এই তরুণদের সাথে থেকে ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, আপনারা বিপ্লবকে ধারণ করুন, বিপ্লবী সরকার হোন; বিপ্লবী সরকার হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করুন। জনগণের চাহিদা অনুযায়ী একটা সংবিধান রচনা করুন। ড. ইউনুসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এখনো সময় আছে আপনি অনতিবিলম্বে আপনার সরকারকে বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করুন এবং নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করুন। অতঃপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করো একটি নতুন জনগণের সংবিধান রচনা করুন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যে গণরুম, গেস্টরুম কালচার ছিল তা ছিল একেকজন আবরার ফাহাদকে নির্মম নির্যাতনের প্রতীক। আমরা হলে সিট পেয়েছি চতুর্থ বর্ষে উঠে। অথচ ছাত্রলীগের আদু ভাইয়েরা ৯ থেকে ১০ বছর করে একেক জন সিঙ্গেল রুমে ছিল। যেখানে চারজনের রুমে আমাদেরকে ৪০ জন থাকতে হয়েছে সেখানে তারা একাই ছিল। গণরুম গেস্টরুমের নির্যাতনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের এমনকি কোনো কোনো দিন কেটেছে যে ফজরের আযানের সময়ও গেস্টরুম চলেছে। সুতরাং অতীতের সেই অপশাসন, অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি যেন ফিরে না আসে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
আন্দোলনের আরেক অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, গত ১৬ বছর ধরে ক্যাম্পাসে যে নির্যাতনের খড়ক চালিয়েছে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী বাহিনী আজকে তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। যখন একজন শিক্ষার্থীকে শিবির সিদ্ধান্তে রাজনৈতিকভাবে নির্যাতন জায়েজ মনে করা হয়েছে তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? গত ১৬ বছর ধরে আমাদের মত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? আজকে তারা কি প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে যে তাদেরকে মাফ করে দেওয়া হবে! আমরা বলতে চাই, গত ১৬ বছর ধরে আমাদের উপর যারা নির্যাতন চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে, এবং যেই প্রশাসন ছাত্রলীগের এসব নির্যাতনে প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও চার্জশিট আনতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, শহীদ আবরার ফাহাদ আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক ও আগ্রাসন বিরোধী প্রতীক। তার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দুটি জিনিস স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তার একটি হলো আওয়ামী লীগের নির্যাতন অন্যটি হল ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম।
৭২ এর সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, যেই সংবিধান গত দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষের উপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে সেই সংবিধান এখনো কীভাবে বহাল থাকে? কীভাবে ফ্যাসিবাদের দোসর প্রেসিডেন্ট এখনও বহাল থাকে? কীভাবে সেই বিচারকরাই এখনো রায় দিচ্ছে যাদের রায়ে আমাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে? গত ১৫ বছরের ন্যায় ৫৩ বছর যেই সংবিধান আমাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি নতুন বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের এই স্পিরিটকে ধারণ করে সেই সংবিধানকে নতুন করে লিখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ৭ অক্টোবরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আগ্রাসন বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, আবরার ফাহাদ একক কোন ব্যক্তি নয়, কোটি কোটি বাংলাদেশীর স্বাধীনতার প্রতীক। আজ তার শাহাদাতের ৫ বছর হয়ে গেছে। সেদিন যখন আমরা তার মৃত্যুর সংবাদ শুনেছিলাম তখন একটা মিছিলও করতে পারিনি। ২০২০ সালে তার স্মরণে ৮টি স্তম্ভ করেছিলাম, তখন ছিলাম আমরা গুটিকয়েক। কিন্তু আজকে প্রমাণ হয়েছে আমরা গুটিকয়েক নয়, হাজার হাজার। তিনি বলেন বাংলাদেশের মানুষ কোন দেশের আগ্রাসনকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।
স্মরণসভা শেষে পলাশী মোড়ে শহীদ আবরার ফাহাদের স্মরণে ৮টি ফলক বিশিষ্ট স্তম্ভের পুনর্র্নিমাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাহমুদুর রহমানসহ অন্যান্যরা। এসময় আবরার ফাহাদের বাবা, ছোটভাই সহ আরো বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য রাখেন। আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, আবরার ফাহাদ দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। প্রথম দুই বছর হত্যার বিচারের জন্য আমাদেরকে বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। রায়ের তিন বছর পার হলেও আমরা এখনও হত্যার বিচার পাইনি। যে আট স্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে সেটা যেন যেকোনো বাধা-বিপত্তিতেও টিকে থাকে।
দিনকাল/এসএস