দালালের কথায় ‘চোখ বন্ধ করে’ সিল মারেন ইমিগ্রেশন অফিসার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪৩ পিএম, ২৬ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৪৯ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দালালরা অনুমতি দিলে বা ইঙ্গিত দিলেই কেবল যাত্রীদের পাসপোর্টে সিল মারেন বুড়িমারী স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসাররা। আর দালালরা যদি কোনো ইঙ্গিত না দেন তাহলে ওইসব পাসপোর্টে হাতও দেন না তারা। গত ৭ দিনে ৩ বার বুড়িমারী স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে। বুড়িমারী স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারটি ১১০ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে প্রবেশ করতে হলে ১১২ নম্বর কক্ষের গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। ১১২ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে যাত্রীরা প্রথমে ৫০ টাকার ল্যান্ড পোর্ট চার্জ দেন। চার্জ দেয়ার পর ১১০ নম্বর কক্ষে ইমিগ্রেশন করতে যান। এই স্থল বন্দরে ইমিগ্রেশন করার নিয়ম হলো যাত্রীদের দল (যারা একসঙ্গে বন্দর পার হবেন) একসঙ্গে তাদের পাসপোর্ট নিয়ে ১১০ নম্বর কক্ষে রেখে আসবেন। এরপর ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট ধরে ধরে একে একে যাত্রীদের নাম ডাকবেন আর যাত্রীরা গিয়ে অফিসারের সামনে হাজির হয়ে নিজ নিজ ইমিগ্রেশন করবেন। তবে সরেজমিনে দেখা গেল উল্টো চিত্র। ইমিগ্রেশন পুলিশের ৩ জন সদস্য কাউন্টারে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন পোশাকে। তাদের একজন কনস্টেবল আহসান এবং অপরজন কনস্টেবল সেলিম। আরেকজন ছিলেন গেঞ্জি পরিহিত সাদা পোশাকে। তিনি শুধু পাসপোর্ট সংগ্রহ করছিলেন। পাসপোর্ট নেয়ার পর তিনি যাত্রীদের বলছিলেন, ‘যাত্রীদের বাসের নামের তালিকা অনুযায়ী ডাকা হবে। ১১০ নম্বর ইমিগ্রেশন কক্ষের গেটে ‘নো এন্ট্রি উইদাউট পাসপোর্ট প্যাসেঞ্জার’ (পাসপোর্টধারী যাত্রী ছাড়া অন্যদের প্রবেশ নিষেধ) লেখা থাকলেও ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পাশে সার্বক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকেন ৬-৭ জন দালাল। গেটের বাইরে থাকেন আরও ৮-১০ জন। তাদের কাছে পাসপোর্ট প্রতি ২০০ টাকা দিলে তারাই পাসপোর্ট নিয়ে যান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে। ইমিগ্রেশন অফিসাররা সেসব পাসপোর্টের নাম ধরেই ইমিগ্রেশন করেন। পরে দেখা গেল নিয়মানুযায়ী সাধারণ যাত্রীদের ডাকা হচ্ছে না। দালালদের দেয়া পাসপোর্টের তালিকা অনুযায়ী ইমিগ্রেশন করা হচ্ছে। যিনি সাদা পোশাকে ছিলেন তিনিই মূলত দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। তিনি দালালদের ইশারায় পাসপোর্ট সিরিয়ালে দিচ্ছেন। ১১০ নম্বর ইমিগ্রেশন কক্ষের গেটে ‘নো এন্ট্রি উইদাউট পাসপোর্ট প্যাসেঞ্জার’ (পাসপোর্টধারী যাত্রী ছাড়া অন্যদের প্রবেশ নিষেধ) লেখা থাকলেও ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পাশে সার্বক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকেন ৬-৭ জন দালাল। গেটের বাইরে থাকেন আরও ৮-১০ জন। তাদের কাছে পাসপোর্ট প্রতি ২০০ টাকা দিলে তারাই পাসপোর্ট নিয়ে যান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে। ইমিগ্রেশন অফিসাররা সেসব পাসপোর্টের নাম ধরেই ইমিগ্রেশন করেন। ঢাকা থেকে বুড়িমারী হয়ে ভারতের শিলিগুড়ি যায় বাংলাদেশের শ্যামলী এনআর পরিবহন। এই পরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে বাস কর্তৃপক্ষ নগদ ২০০ টাকা করে আদায় করে। টাকা আদায়ের কারণ হিসেবে তারা বলে ‘পোর্ট পার করানোর খরচ’। যাত্রীরা শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারের লোকজনকে ২০০ টাকা দিলেই তারা পাসপোর্ট ও যাত্রীদের নামের তালিকা নিয়ে চলে যায় ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। সেখানে দালালদের কথা মতো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাত্রীদের ইমিগ্রেশন করেন অফিসাররা। এমনকি কোন যাত্রীর পর কার ইমিগ্রেশন হবে সেই তালিকা তৈরি করে একে একে ডাক দেন দালালরা।
সেই বাসের একজন যাত্রী বলেন, আমরা বুড়িমারী আসার পরই বাস থেকে ২০০ টাকা নিল। তারা আমার পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন কার্ড পূরণ করে দিল। ১০ মিনিটের মধ্যে আমার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এই রুটে চলাচলকারী বরকত পরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে ইমিগ্রেশন বাবদ ২৫০ টাকা নেয়া হয়। এই বাসের একজন যাত্রী বলেন, আমরা ৫ জন বরকত পরিবহনের বাসে বুড়িমারী গিয়েছি। সেখান থেকে আমাদের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা। আমরা এ পরিবহনের স্টাফদের ২৫০ টাকা এবং পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানাই। নিজে নিজেই কাউন্টারে পাসপোর্ট জমা দিই। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের বাসের নাম জিজ্ঞেস করলে আমরা ‘বরকত পরিবহন’ বলে জানাই। তখন বরকত পরিবহনের একজন দালাল বলে ওঠেন, ‘তারা আমাদের সাথে না’। এ কথা বলার পর ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের পাসপোর্ট ফেলে রাখে! কমপক্ষে ২০০ থেকে ২৫০ জনের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হওয়ার পর আমাদের ইমিগ্রেশন করা হয়।
ভারতগামী কমপক্ষে ২০ জন যাত্রীর। তাদের মধ্যে ১৫ জন স্থানীয় দালালকে ২০০-৩০০ টাকা দিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে ইমিগ্রেশন করিয়েছেন। বাকি ৫ জন ফাঁকা লাইন পেয়েও ২ ঘণ্টা পর ইমিগ্রেশন করতে পেরেছেন। ইমিগ্রেশন কাউন্টার কিংবা এর আশপাশের কক্ষে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, ফলে দালাল ও ইমিগ্রেশন অফিসারদের এ যোগসাজশ কারও চোখে পড়ে না। স্থলবন্দরে দায়িত্বরত পুলিশের কনস্টেবল ‘আহসান’কে দালালরা নাম ধরে ‘আহসান, আহসান’ বলে ডাকছিলেন। তারা ইমিগ্রেশন অফিসারকে ‘তুই’ বলেও সম্বোধন করছিলেন। কনস্টেবল আহসানকে ডাকা ওই দালালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের পরিচিত। আমরা দ্রুত ইমিগ্রেশন করিয়ে দিই। পুলিশকে পাসপোর্ট প্রতি ১০০ টাকা দিতে হয়। আপনারা গেলে সময় বেশি লাগবে। এই স্থল বন্দরে ইমিগ্রেশন করার নিয়ম হলো যাত্রীদের দল (যারা একসঙ্গে বন্দর পার হবেন) একসঙ্গে তাদের পাসপোর্ট নিয়ে ১১০ নম্বর কক্ষে রেখে আসবেন। এরপর ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট ধরে ধরে একে একে যাত্রীদের নাম ডাকবেন আর যাত্রীরা গিয়ে অফিসারের সামনে হাজির হয়ে নিজ নিজ ইমিগ্রেশন করবেন।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশনের লাইন দীর্ঘ হলেও বাংলাদেশে ফেরার সময় চিত্রটা ভিন্ন। ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার স্থল বন্দরে ১০০ টাকা দিলেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হয়ে যায় ইমিগ্রেশন। রোববার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, শ্যামলী এনআর পরিবহনের যাত্রীদের কাছে বাংলাদেশে নগদ ১০০ টাকা নেয় স্থানীয় দালালরা। এরপর পাসপোর্ট নিয়ে দালালরাই ইমিগ্রেশন করিয়ে আনে। রাজীব নামে এক যাত্রী বলেন, আমি বাংলাদেশে ফেরার সময় বন্দরে একজন দালাল ১০০ টাকা নিয়েছে। এরপর সে আমার পরিবারের ৩ জনের পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন করিয়ে আমার হাতে দিয়েছে। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ প্রত্যোক যাত্রীর আলাদা ইমিগ্রেশন করলেও এই বন্দরে দেখলাম যাত্রীর উপস্থিতি ছাড়াই ইমিগ্রেশন করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে বুড়িমারী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. হাসান কবির বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি, ৫-৭ দিন হয়েছে। আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। দেখা করে আলাপ করি, কী বিষয়ে জানতে চান সেটা শুনি। আমার মনে হয় আপনি সামনা সামনি এলে কথা বলা যাবে। আপনার সঙ্গে তো আমার দেখা হয়নি। ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে দালালের সখ্যতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারই সিল দেয়। অন্য কেউ দেয় না। অন্য কারো (দালাল) এখানে ভূমিকা নেই।