ঢাকা ওয়াসায় ১৩২ কোটি টাকা লোপাট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২০ পিএম, ২৫ জুলাই,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৫৭ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতিতে ১৩২ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় প্রতিবাদকারীদের দন্ড দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। আর অর্থ লোপাটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এক কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। অন্যরাও বহালতবিয়তে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এমন ঘটনায় ঢাকা ওয়াসার সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রীতিমতো হতবাক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সমবায় অধিদফতরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা থেকে কমিশন বাবদ প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। অথচ সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জমা দেখানো হয়েছে মাত্র এক কোটি ৭৯ লাখ টাকা আয় করেছে ওই সময়ে। বাকি প্রায় ১৩২ কোটি টাকার কোনো হিসাব নিরীক্ষা দল পায়নি। ওই সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আর ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সমিতির ব্যাংক হিসাব থেকে ৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এই টাকা ব্যয়ের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির বিপুল আয়ের উৎস গ্রাহকের কাছ থেকে আদায়কৃত বিল থেকে পাওয়া কমিশন। ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঢাকা ওয়াসার সাতটি রাজস্ব অঞ্চলে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়ের কাজ করে। এর বিপরীতে কর্মচারী সমিতি মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন হিসাবে পেয়েছে। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ওপর এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে ২০২১ সালের জুনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সমবায় অধিদপ্তর ও ঢাকা ওয়াসাকে দেয়া হয়। এতে আর্থিক অনিয়ম নিয়ে অধিকতর তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জমান ছিলেন কর্মচারী সমিতির তৎকালীন (অর্থ লোপাটের ঘটনা) কমিটির সভাপতি ও বিল আদায় কার্যক্রমের অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান। আর ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ছিলেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। আর অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে থাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক মিয়া মো. মিজানুর রহমান ছিলেন বিল আদায় কার্যক্রমের কো-চেয়ারম্যান। কমিটির সদস্য হিসাবে ছিলেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আরমান ভূইয়া।
সমবায় অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের কমিটি দায়িত্বে থাকার সময় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা দলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সমবায় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে ঢাকা ওয়াসা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাকে ঢাকা শহরভুক্ত ১৬ ইউনিয়ন বা নতুন ৩৬ ওয়ার্ডের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নিয়োগ করা হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর গুলশান-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যর্থতা চিহ্নিত করে এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তখনো ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কমিটির অন্য সদস্যরাও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। এদের একজন স্বাভাবিক নিয়মেই অবসরকালীন ছুটি ভোগ করছেন। এজন্য ঢাকা ওয়াসার সংক্ষুব্ধরা বলছেন, তাদের দুর্নীতির সঙ্গে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জড়িত। এ কারণে বারবার তার দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার কর্মচারী সমিতির অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে প্রতিবাদ করায় ২৯ মে চাকরিচ্যুত হয়েছেন সংস্থার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোজাম্মেল হক। তার চাকরির অপসারণের মূল কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা ওয়াসা ভবনে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম উপস্থিত হন। ওই সময়ে ঢাকা ওয়াসা ভবনের সামনে অবস্থানরত ঢাকা ওয়াসার কিছু শ্রমিক-কর্মচারী এবং বহিরাগত তার নির্দেশে বিক্ষোভ করেন।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা ওয়াসায় একটি সমন্বয় সভায় যোগদান করেছিলাম। সেটা সঠিক, কিন্তু সেসময় কোনো প্রকৌশলী বা কর্মচারী আমাকে অপমান বা অবজ্ঞা করেছে এমন ঘটনা ঘটেনি। আর গত ১৫ মার্চ তারিখ দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাবুদ্দিন সরকারকে বরখাস্ত করে ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন। অভিযুক্তদের দাবি, এটা এপ্রিলের শেষে ইস্যু করা হয়েছে পেছনের তারিখে। কারণ এপ্রিল থেকে তার অবসরকালীন ছুটি শুরু হয়েছে। এই সময়ে কাউকে বরখাস্ত করা যায় না।
এজন্য পেছনের তারিখে এই আদেশ জারি করা হয়েছে। অথচ এপ্রিলের খোরাকি ভাতাও পরিশোধ করা হয়েছে তাকে। গত মার্চে তাকে বরখাস্ত করা হলে খোরাকি ভাতা বন্ধ করে দেয়া হতো। এছাড়া কর্মচারী সমবায় সমিতির দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় সমিতির সহসভাপতি ও উপপ্রধান প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলামকে গত ৮ মে বরখাস্ত করা হয়। তাকে বরখাস্ত করা হয় সমিতির দুর্নীতির বিষয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে। ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব পরিদর্শক ও ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের মহাসচিব মো. আজিজুল ইসলামকে ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন ‘ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ’-এর নামে তিনি নিজেকে সদস্য হিসাবে উল্লেখ করে ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালায়। এই কর্মকান্ড চাকরি বিধিমালার পরিপন্থি হওয়ায় তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একইভাবে ১৯ মে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ আতাউল করিমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা জানান, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির ১৩২ কোটি টাকা লোপাটের একটি ঘটনার কথা শুনেছি। সংক্ষুব্ধরা ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের কাছে এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছে। সেটা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। তিনি আরও বলেন, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির ১৩২ কোটি টাকা লোপাটের বিষয়ে জড়িত থাকার বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জমানের নাম আলোচনা হয়েছে। সমবায়ের তদন্তেও নাকি এমন কিছু বলা হয়েছে। সেটা ঢাকা ওয়াসা প্রশাসনের দেখভালের বিষয়। সাধারণত এ ধরনের অভিযোগ থাকলে ওই প্রকৌশলী বা কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব না দেয়া উচিত। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকলে সেটাও নিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ঢাকা ওয়াসায় কর্তৃপক্ষ এমন কোনো ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, সেটা খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন বলে জানান