রানা প্লাজা ধস, শেষ হয়নি বিচার ৯ বছরেও
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫৮ পিএম, ২৪ এপ্রিল,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:৫৬ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
৯ বছর আগে এই দিনে ঢাকার অদূরে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন নিহত হন। এ ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলার বিচার ৯ বছরেও শেষ হয়নি।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আসামিদের কালক্ষেপণে মামলার বিচার এগোচ্ছে না। তবে আসামিপক্ষ চাইছে, মামলার বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়। এতে যারা ভুক্তভোগী হয়েছেন তারা ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন। এদিকে, দায়ীদের বিচার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
রানা প্লাজা ধসের পরপরই বেশ কয়েকটি মামলা হলেও মূল মামলা দুটি। এর একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে, অপরটি ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে অধিকাংশ আসামি জামিনে এবং পলাতক রয়েছেন। দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মামলার বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
মামলার দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। যার একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা ও তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে এবং অপরটিতে ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুটি চার্জশিটে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। এ দুটি মামলায় পৃথক দুই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। তবে দুটি মামলায় আসামিপক্ষ চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করায় এবং কয়েকজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ থাকে। দীর্ঘদিন পর হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। তবে স্থগিতাদেশ থাকায় থমকে আছে ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির মামলাটি।
রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে। রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বকর সিদ্দিক ও আসামি আবুল হোসেন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হাবিবুর রহমান ভূইয়ার আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। প্রায় ৬ বছর পর এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি মামলার বাদী এসআই আলী আশরাফ সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন। গত ১৬ এপ্রিল তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। আগামী ২৯ মে মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে।
মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বিমল সমদ্দার বলেন, অভিযোগ গঠনের পর ৮ জন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে ৭ জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে মামলার বিচারিক কার্যক্রম এখনো স্থগিত রয়েছে। তাকে বাদ দিয়ে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আগে সাক্ষীরা আদালতে আসলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায়নি। এখন সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আমরাও রাষ্ট্রঈক্ষ থেকে প্রস্তুত সাক্ষী নেওয়ার জন্য। আশা করছি, সাক্ষ্য গ্রহণ চলবে। মামলার বিচার দ্রুত শেষ হবে।
রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘এটা একটা দুর্ঘটনার মামলা। সেই মামলায় রানা গত ৯ বছর ধরে জেল হাজতে রয়েছে। জামিন পাচ্ছেন না। বাকি সবাই জামিনে আছে। মামলার রায়ে যা হওয়ার তাই হবে। এভাবে বিনা বিচারের ৮ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই আদালতের উচিত হয়তো মামলার বিচার দ্রুত শেষ করা, নয়তো আসামিকে জামিন দেওয়া।’
ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। সিআইডি তদন্ত শেষে এ মামলায় সোহেল রানা ও তার বাবা-মাসহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় এ চার্জশিট দাখিল করে। এ মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। চার্জগঠনের আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি রিভিশন করায় মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে না।
ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা সম্পর্কে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বাবুল বলেন, কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন আবেদন করেন। তাদের মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলার আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহর পক্ষে গত ৭ নভেম্বর এক বছরের জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষের কারণে মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে আমরা এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারি। মামলাটি চার্জগঠনের পর পরেই রিভিশনে চলে যায়। এজন্য একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া সম্ভব হয়নি।’
শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) যুগ্ম-সমন্বয়কারী চৌধুরী আশিকুল আলম এবং আহসান হাবিব বুলবুল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানান, ‘জীবিকার জন্য কাজ করতে এসে জীবন হারানো মানবিক সমাজের বৈশিষ্ট্য নয়। তাছাড়া অসময়ে একজন কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারকে অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দেয় যা সমাজের ভারসাম্যহীনতা বাড়ায়, ব্যক্তিগত অতিমুনাফ প্রবণতার দায় রাষ্ট্রের কাঁধে চাপে। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবহেলা, বিচারহীনতা এবং দুর্ঘটনার দায় থেকে মালিককে দায়মুক্তি দেওয়ার নীতির কারণে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যুরমত অমানবিক ঘটনা অব্যাহত আছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে দায়িত্ব অবহেলাকারীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপনের আহবান জানান তারা।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়।