১১ প্রাণহানির মধ্যদিয়ে শেষ হল পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০১ পিএম, ৬ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৪৩ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
পঞ্চম ধাপে সাত শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় নারীসহ ১১ জন নিহত হয়েছেন।
গতকাল বুধবার (৫ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় শুরু হয়ে বিকাল চারটা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সহিংসতায় ১১ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। এই ধাপেও চেয়ারম্যান পদে পেশিশক্তি প্রদর্শন ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। ভোটগ্রহণ শেষে গতকাল বিকালে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সাংবাদিকদের বলেছেন, পঞ্চম ধাপে দেশের ৭০৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ নির্বাচন কেন্দ্র করে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে। তার পরও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট খুব ভালো হয়েছে।
সচিব বলেন, ৭০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়ার আশা করছি। নির্বাচন ভালো হয়েছে। সামনে আরও ভালো হবে। এই ভোটে অনিয়মের কারণে ৯টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে।
ভোট দিতে গিয়ে যাদের প্রাণ গেল, এ দায় কার? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রার্থী ও সমর্থকরা দায় নেবে। তারা কেন এটি করছেন? এ সময় প্রার্থী ও সমর্থকদের অতি আবেগী না হওয়ারও আহ্বান জানান সচিব। এদিকে গতকাল সকাল থেকে ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীত উপেক্ষা করে ভোটাররা দলে দলে ভোটকেন্দ্রে আসেন। কেন্দ্রগুলোয় নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুসারে, পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে নিহতের সংখ্যা ১১। এর মধ্যে চাঁদপুরের কচুয়া ও হাইমচরে একজন করে, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ১, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে ১, বগুড়ার গাবতলীতে ৪, গাইবান্ধার সাঘাটায় ১, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ১ জন ও নওগাঁয় একজন নিহত হয়েছেন। এর আগে প্রথম ধাপে ৫ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩২, তৃতীয় ধাপে ২৭, চতুর্থ ধাপে ১৪ ও পঞ্চম ধাপে ১১ জন নিহত হন।
চাঁদপুর:
নির্বাচনী সহিংসতায় গতকাল চাঁদপুরের কচুয়া ও হাইমচরে ২ জন নিহত হন। পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কচুয়া উপজেলার সাচার এলাকায় নিহত যুবকের নাম শরীফ হোসেন। তিনি উপজেলার হাতিরবন্ধ এলাকার শহীদ উল্লাহর ছেলে। অপর নিহতের নাম-পরিচয় পাওয়া না গেলেও তিনি পার্শ্ববর্তী শরীয়তপুরের বাসিন্দা বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
কচুয়ায় দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন শরীফ। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। হাইমচরের নীলকমল ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাহেরচর এলাকায় বিকাল সাড়ে ৩টায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তি ছুরিকাঘাতে নিহত হন। হাইমচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান মোল্লা জানান, নীলকমল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৩শ গজ উত্তরে লাশটি পাওয়া যায়। তবে এটি নির্বাচনী সহিংসতায় কিনা এখনো জানা যায়নি। পুলিশি তদন্ত চলছে।
গাইবান্ধা:
সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শ ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ইউপি মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আবু তাহের (৩২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। বেলা পৌনে ৩টার দিকে এ সংঘর্ষ হয়। আবু তাহের জুমারবাড়ি ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের মো. ওমর আলীর ছেলে। এ ছাড়া ওই ঘটনায় ৩ ব্যক্তি আহত হন। গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বি-সার্কেল) ইলিয়াস জিকো জানান, টিউবওয়েল প্রতীকের মেম্বার প্রার্থী আজিজল মিয়ার সমর্থক আবু তাহেরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী পাখা প্রতীকের মেম্বার প্রার্থী রাসেল আহমেদের কর্মী-সমর্থকদের কথা-কাটাকাটি থেকে সংঘর্ষ হয়। এ সময় আবু তাহেরকে একা পেয়ে রাসেলের কর্মীরা হাঁসুয়া দিয়ে গলা কেটে দেয়। সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তাহেরের মৃত্যু হয়।
মানিকগঞ্জ:
দৌলতপুর উপজেলায় ভোটকেন্দ্রের পাশে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে সমেলা খাতুন (৫০) নামের এক নারী নিহত হন। দুপুরে উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের বাচামারা ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের পাশে এ ঘটনা ঘটে। সমেলা ওই এলাকার মাহাতাবের স্ত্রী। বিষয়টি নিশ্চিত করেন শিবালয় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানিয়া সুলতানা। তিনি আরও জানান, ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া হরিরামপুর উপজেলার গালা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারেরর দায়ে ১০ জনকে ৭ দিনের কারাদন্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক।
চট্টগ্রাম:
আনোয়ারায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হন। তার নাম অংকুর দত্ত (৩৮)। তিনি সিংহরা দত্ত বাড়ির নেপাল দত্তের ছেলে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চাতরী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিংহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান থানা নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আনোয়ার খালেদ। আপেল প্রতীকের মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় আহত হন অংকুর। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম দিদারুল ইসলাম সিকদার জানান, মেম্বার প্রার্থী রঘুনাথ শিকদার ও নাজিম উদ্দীনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এদিকে উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ভোট বর্জন করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নাজিম উদ্দিন। তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী মামুনুর রশিদ চৌধুরী আশরাফের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করেন।
ঝিনাইদহ:
শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত অখিল সরকার নামের আরও এক ব্যক্তি গতকাল কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এ নিয়ে ইউনিয়নটিতে নির্বাচনী সহিংসতায় তিনজন মারা গেলেন। অখিল সরকার কিত্তিনগর গ্রামের নিরাপদ সরকারের ছেলে। শৈলকুপা থানার সেকেন্ড অফিসার উপপরিদর্শক আমিরুজ্জামান জানান, গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসান মামুন ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীর (আনারস) সমর্থকদের মধ্যে কাতলাগাড়ী বাজারে সংঘর্ষ হয়। এতে হারান বিশ্বাস নামের একজন নিহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় অখিল সরকারকে কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে অখিল চিকিৎসাধীন মারা যান। নিহতরা সবাই নৌকার সমর্থক বলে জানান চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসান।
জামালপুর:
বকশীগঞ্জের মেরুরচর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেরুরচর হাসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোয়ার হোসেন হক ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হয়। এতে একজন কর্মকর্তাসহ অন্তত ১০ পুলিশ আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। এ সময় পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দীন আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আতাউর রহমান জানান, ঘটনার পর থেকে কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়।
বগুড়া:
গাবতলীতে ভোটকেন্দ্রে নৌকার কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে গুলিতে নারী মেম্বার প্রার্থীসহ চারজন নিহত হন। গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলার বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের কালাইহাটা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন উপজেলার বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের কালাইহাটা গ্রামের খোকনের স্ত্রী মেম্বার প্রার্থী কুলসুম আক্তার, মকবুল হোসেনের ছেলে আলমগীর হোসেন, মৃত ইফাত উল্লাহর ছেলে আবদুর রশিদ ও আবদুর রাজ্জাক। নিহত চারজন্যই কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা। তবে নিহত রাজ্জাকের বাবার নাম জানা যায়নি। বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেছেন, আমাদের কাছে নিহত তিনজনের নাম রয়েছে। পরে রাজ্জাক নামের একজনের মরদেহ গাবতলী হাসপাতালে রয়েছে বলে শুনেছি।
পুলিশ সূত্র জানায়, ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণা না করা নিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে নৌকার কর্মী-সমর্থকরা। তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজিবি ও পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। রাত ৮টার দিকে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এলে কেন্দ্রেই ব্যালট পেপার গণনা শেষে ফল ঘোষণা করা হয়।
নওগাঁ:
পত্নীতলা উপজেলার ঘোষনগর ইউনিয়নের ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট বাক্স নিয়ে উপজেলা সদরে আসছিলেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। পথে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ফারজানা পারভীনের সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহত হন ২০ জন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ২ জন রয়েছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।