প্রবীণ সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে অশ্রুসজলে শেষ শ্রদ্ধা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩৭ এএম, ২৭ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:২৯ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
প্রবীণ সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে অশ্রুসজলে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সাংবাদিকরা।
আজ রবিবার সকাল ১১টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মরহুমের কফিন জাতীয় প্রেসক্লাবের টেনিস কোর্টে আনার পর কালো কাপড়ে ঘেরা একটি অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয়। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা শ্রদ্ধা জানান ফুলের স্তবক দিয়ে। লাশের চারপাশে শুধু সাংবাদিক নন, নানা শ্রেণি- পেশার মানুষের অশ্রুসজল ফুলে ফুলে ভরে যায়। কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর নয় দিন আগে রিয়াজ উদ্দিনকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছিল। শনিবার দুপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ কয়েকবার সাংবাদিকদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। আবার নবীন অনেক সাংবাদিক তাকে তাদের ‘বাতিঘর’ হিসেবে মনে করে। নানা সংকটে সাংবাদিক-কর্মচারীরা তার কাছে ছুটে যেতেন সমাধানের পথ খুঁজতে। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে মাশরুর রিয়াজ জানান, বাবার লাশ হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নরসিংদীর গ্রামের বাড়ি নারান্দীতে। সেখানে বাদ জোহর নামাজে জানাজা শেষে হেলিকপ্টারে করে আবার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। এরপর বাদ আসর বারিধারা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে বিকালে বনানীতে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে।
জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রথম নামাজে জানাজায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ, ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, নিউ এজের প্রকাশক এসএসএম শহিদুল্লাহ খান, এডিটরস গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, শওকত মাহমুদ, সাইফুল আলম প্রমুখ অংশ নেন। এছাড়া জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শাহজাহান মিয়া, স্বপন সাহা, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, এম এ আজিজ, বদিউল আলম, গোলাম মহিউদ্দিন খান, আবদুল হাই শিকদার, রফিকুর রহমান, এলাহী নেওয়াজ খান, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল হাই সিদ্দিকী, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এম আবদুল্লাহ, নুরুল আমিন রোকন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের কাদের গনি চৌধুরী, শহিদুল ইসলাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের ইলিয়াস খান, শাহেদ চৌধুরী, মাইনুল আলম, আশরাফ আলী, কাজী রওনাক হোসেন, বখতিয়ার রানা, কাদির কল্লোল, লোটন একরাম, আকরামুল হাসান, শামসুদ্দিন দিদার, ন্যাপের গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়াসহ রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
রিয়াজ ভাইয়ের বিদায় অপূরণীয় : জানাজার আগে ক্লাবের টেনিস কোর্ট প্রাঙ্গণে মরহুম রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের কফিন সামনে রেখে শ্রদ্ধা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ শাহেদ চৌধুরীর পরিচালনায় এতে ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে মরহুম রিয়াজ উদ্দিনের ভাই অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল জয়নাল আবেদীন ও মরহুমের একমাত্র ছেলে মাশরুর রিয়াজও ছিলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, ‘‘রিয়াজ ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাদের সকলের জন্যই বেদনার-কষ্টের। উনি সেই সাংবাদিক যিনি গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে, তার মেধা দিয়ে সাংবাদিকতাকে সবসময় সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। আমি মনে করি, এই সময়ে যখন গণতন্ত্রের একটা সংকট চলছে তখন তার মতো সাংবাদিকের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে তার একটা বড় শূন্যতা অনুভব করছি। তার বিদেহী আত্মার আমি শান্তি কামনা করছি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, তার এই মৃত্যু অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে সাংবাদিকতার পেশায়। পৃথিবীতে শূন্যতা থাকে না। হয়ত ওনাকে হারানো যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা এখনই পূরণ হবে না। তবে ওনার ভালোর গুণগুলো আমাদের সকলের স্মরণ রাখা দরকার। তার সাহস, দেশপ্রেম, বস্তুনিষ্ঠতা, সাংবাদিক শ্রেণির জন্য তার দরদ-অবদানকে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘‘আমি রিয়াজ ভাইয়ের পরলোকগমনে অত্যন্ত মর্মাহত, ব্যথিত। আমি ওনাকে খুব মনে-প্রাণে শ্রদ্ধা করতাম। উনি আমাদের সম্পাদক পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ওনার সঙ্গে অনেক সাংবাদিকের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা-সংগ্রাম, সাংবাদিকদের একটা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির আন্দোলন, অনেক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সাথে আমার থাকবার সুভাগ্য হয়েছিল। আমি ওনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ওনারকে আল্লাহ যেন বেহেশতবাসী করেন। রিয়াজ ভাইয়ের যে একটা খুবই উদার মনোভাব, সবার সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করার একটা স্বভাবসুলভ গুণ ছিল আমরা যেন সেই গুণ আমাদের মধ্যে আনতে পারি। ওনার সাংবাদিকতার মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা নিজেরাও যেন আরো অধিকতর স্তরের সাংবাদিক হতে পারি এই প্রত্যাশা রইল।
নিউজ পেপারস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ বলেন, রিয়াজ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের তবে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি দিনের না। যেভাবে আমি দেখেছি একজন পেশাদারি সাংবাদিক হিসেবে যতগুলো গুণ থাকা দরকার আন্তর্জাতিক লেভেলে এবং দেশীয় লেভেলে প্রত্যেকটা গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে তিনি নোয়াবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে যখনই কোনো কিছু আমাদের কাছে আসতো তখনই আমরা রিয়াজ ভাইকে দায়িত্ব দিতাম নোয়াবের সাথে সাংবাদিকদের একটা সমন্বয় করার জন্য এবং তাকে এটাও বলতাম আপনি কিন্তু সাংবাদিকদের পক্ষ নিয়েন না, আপনি নিরপেক্ষ থাইকেন। উনি কিন্তু নিরপেক্ষভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি বলব, রিয়াজ ভাইয়ের জীবনের যে উল্লেখযোগ্য অবদান এই প্রেসক্লাবের জন্য, সাংবাদিকদের জন্য, সাংবাদিক ইউনিয়নের জন্য নতুন প্রজন্ম যেন তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি যে, রিয়াজ ভাইয়ের আদর্শকে যেন আমরা ধারণ করতে পারি। তিনি আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শওকত মাহমুদ বলেন, রিয়াজ ভাই তার সাংবাদিকতার চৈতন্যবোধ দিয়ে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবে যখন তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন তখন আমিও তার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমি লক্ষ্য করেছি যে, সাংবাদিকতার প্রতি তার যে মর্মত্ববোধ, সাংবাদিকতার প্রতি তার যে দায়িত্ববোধ, সর্বোপরি গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার জন্য তার যে ভূমিকা তিনি তা নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন। আজকে আমরা অভিভাবক শূন্য হয়ে গেছি। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন- সাংবাদিকদের অধিকার, জনগণের অধিকার এসব মিলিয়ে সাংবাদিকতার পেশার প্রতি তার দায়িত্ববোধে এমন এক ভূমিকা পালন করেছেন যে, তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ‘‘রিয়াজ ভাই একজন ভালো সংগঠন ছিলেন, ভালো অভিভাবক ছিলেন। পেশার প্রতি তার যে আত্মনিবেদন তার কোনো তুলনা নেই। সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে কখনো তিনি আপোস করেন নাই। সাংবাদিক-কর্মচারীর স্বার্থের প্রতি তিনি সবসময় অবিচল ছিলেন। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মতানৈক্য কখনোই মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে না এটা আমরা রিয়াজ ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি। মতানৈক্য থাকতেই পারে কিন্তু সেখানে দূরত্ব নাই। সেই মতানৈক্য গ্রহণ করা, মতানৈক্য নিয়ে আলোচনা করার মানসিকতায় তিনি আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সারা জীবন। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আমাদের অভিভাবক, শুধু অভিভাবক বললে ভুল হবে আমাদের অভিভাবকের উপরে যদি কিছু থাকে আমাদের অত্যন্ত প্রিয়জন রিয়াজ ভাইকে নিস্তব্ধ নিথর রেখে আজকে আমরা কথা বলছি এটা আমরা কয়েকদিন আগেও ভাবতে পারিনি। কয়েকদিন আগেও উনি এসে রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। আমরা এমন একজনকে হারিয়েছি যে আমাদের যেকোনো সংকটে আমরা যার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, তিনি আমাদেরকে পরামর্শ দিতেন আমরা তেমন একজনকে হারিয়েছি। সাংবাদিক সমাজ যেমন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জাতীয় প্রেসক্লাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আমরা যারা কমিটিতে আছি ক্লাব পরিচালনা করি আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তার সম্পর্কে কেউ কোনো নেতিবাচক কথা আমি বিশ্বাস করি, জেনেছি, দেখেছি যে, কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। উনি এতো অমায়িক এতো ভদ্র এবং সাংবাদিকতার আমরা যেটাকে বলি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এসব বিষয়গুলোতে উনি যতটা মনোযোগ দিতেন সেগুলো আমরা দারুণভাবে মিস করবো, আমরা আমাদের অভিভাবককে মিস করবো। সাংবাদিকতা জগতে তার যে অভাব সেটি পূরণ হবার নয়। গত বছরের করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত ক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসান শাহরিয়ারসহ ৩৯ জন সদস্য এবং গতকালও আরো একজন সদস্য সৈয়দ আকরামের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তাদের আত্মার মাগফেরাতও কামনা করেন ক্লাব সভাপতি। জানাজা শেষে জাতীয় প্রেসক্লাব, সম্পাদক পরিষদ, এডিটরস গিল্ড, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, নোয়াব, ওকাব, পিআইবি, ডিইউ-৬৭ ক্লাব, জাতীয় প্রেসক্লাব কর্মচারী ইউনিয়ন, সমকাল, নিউজ টুডে প্রভৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়াত সাংবাদিকের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। অর্ধ শতকের সাংবাদিকতা জীবনে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদক, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক, ডেইলি টেলিগ্রাফের সম্পাদক, নিউজ টুডের সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।