বঙ্গবন্ধুর সব স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেব না : শেখ হাসিনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:১০ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০২:৩১ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি তাঁর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে শিখেছেন, কীভাবে বঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হয়। কীভাবে তাদের জন্য সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এমআইটি প্রেস ডাইরেক্টে প্রকাশিত নিবন্ধে এসব কথা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) স্বপ্ন দেখেছিলেন আবারও একটি সোনার বাংলা তৈরি করার, যেমনটি আমাদের ভূমি প্রাচীনকালে পরিচিত ছিল। তিনি গণতন্ত্র, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এটি শেষ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ও সারা জীবনের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছিল। আমি সব সময় তাঁর পরামর্শ ও উদাহরণ অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।’
শেখ হাসিনা তাঁর বাবার কথা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘তুমি কি চটকদার, দামি শাড়ি-গয়না পরবে? বেশির ভাগ মানুষ আজকাল একবেলা খাবারও খেতে পারে না, আর তুমি কি দেখাতে চাও, তুমি কতটা ধনী? দয়া করে এগুলো পরিধান করবে না, সাধারণ কিছু পরিধান করবে, যাতে তুমি এই দেশের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে পারো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের সেই কথাগুলো কখনোই ভুলতে পারবেন না, যাঁকে জনগণ ভালোবেসে ‘বঙ্গবন্ধু’ বা বাংলাদেশের বন্ধু বলে ডাকে। ১৯৬০-এর দশকে তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল, যাতে প্রতিফলিত হয় জনগণ তাঁকে কতটা ভালোবাসত। এটি কেবল একটি উপাধি ছিল না, বরং এটি হচ্ছে মানুষের ভালোবাসার প্রতিফলন।
স্বাধীনতার জন্য ২০ বছরের বেশি সময় দীর্ঘ ও কঠোর সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ভূমিকা-নিষ্ঠার ওপর আলোকপাত করে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ তাঁর মধ্যে এসব প্রকৃত গুণ দেখতে পেত, যা তাদের স্বাভাবিকভাবে তাঁর কাছে আকৃষ্ট করত। তাঁর নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা পেতে উৎসাহিত করত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বান জনগণের হৃদয়ে খুব গভীরভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। তাই তারা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে অকল্পনীয় নৃশংসতা চালিয়েছিল, তা কেবল গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবে তাঁর বাবার সিকি শতাব্দী ধরে লালন করা স্বপ্ন পূরণ হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, অতীতে বঙ্গবন্ধুর ঘন ঘন কারাবরণ করার কারণে তিনি, তাঁর বোন ও ভাইয়েরা তাঁদের বাবার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু কখনোই তাঁর অপার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর মা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে তাঁকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর মা তাঁদের পাশে ছিলেন। তাঁর সন্তানেরা যাতে সঠিক শিক্ষা পায়, তা নিশ্চিত করেছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আমাদের বাবাকে খুব মিস করেছি। তাঁর ঘন ঘন অনুপস্থিতি তাঁর আদর্শবাদের প্রতি আমাদের আনুগত্যকে আরও গভীর করে তুলেছে। তিনি কারাবাসের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। এর কারণ কী ছিল, আমরা তা সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিলাম। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের জন্য অনুরূপ ত্যাগ স্বীকার করা সহজ করে দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের বাবা-মা আমাদের দেশপ্রেমের মূল্য সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন। আমরা জনগণের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁর অবিচল অঙ্গীকার উপলব্ধি করেছিলাম। তাঁরা আমরা যাতে পথ না হারাই, একটি উজ্জ্বল ও উন্নত ভবিষ্যতের আশা না হারাই, তা আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে তাঁর ফিরে আসার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে তাঁর পরিবারের সব সদস্য হারানোর যে বেদনা, তা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। তবে বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের হারানোর বেদনাকে বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াসে রূপান্তরের চেষ্টা করেছেন, যে কারণে তাঁরা আত্মত্যাগ করে গেছেন।
কৃষি, খাদ্য, পুষ্টিসহ জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা-পদক্ষেপ, স্বাস্থ্যশিক্ষা, আশ্রয়ের পাশাপাশি অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা, বিদ্যুৎসুবিধা নিশ্চিত করা, ডিজিটালাইজেশন, আধুনিক প্রযুক্তিতে অগ্রগতি সাধন করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী নিশ্চিত করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থা ও অর্থনীতির উন্নতি সাধন করার কথা তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ অবশ্যই এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। জিডিপি বার্ষিক ৬ শতাংশের বেশি হারে ২০১০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে এটি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে মহামারির কারণে একটি ছোট ধাক্কা লেগেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, একসময় দেশে খাদ্যঘাটতি থাকলেও বাংলাদেশ এখন চাল, অভ্যন্তরীণ মাছ ও সবজি উৎপাদনকারী বিশ্বের শীর্ষ তিনটি দেশের একটি। এটি এখনো দ্রুত তার শস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনছে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, দেশ বিশ্বে সবজি উৎপাদনে পঞ্চম। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ বৃহত্তম। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বঙ্গোপসাগর থেকে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদনও বেড়েছে। দেশ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের পোশাক বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। বাংলাদেশ ২০২০ সালে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আয় ২০২০ সালে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতিসংঘে সম্প্রতি একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যে বাংলাদেশ শিগগিরই স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক দশকের মধ্যে এই আশ্চর্যজনক রূপান্তরটি দুর্ঘটনাক্রমে বা অলৌকিকভাবে ঘটেনি। এটা ঘটেছে পরিকল্পিত প্রচেষ্টা, তৃণমূলের উদ্যোগ ও আমাদের জনগণের উদ্যোক্তা মনোভাবের কারণে, যারা আমাদের প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এটা উদ্যোক্তা কৃষক, গার্মেন্টসশ্রমিক, বিদেশে প্রবাসীদের কঠোর পরিশ্রম, রক্ত, পরিশ্রম ও কান্নার ফসল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মহামারি চলাকালে বাংলাদেশ দুটি বড় মাইলফলক উদ্যাপন করেছে। গত বছরটি তাঁর বাবার ১০০তম জন্মদিন। আর এই বছরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অর্জনের দিকে আমি যখন ফিরে তাকাই, তখন আশা করি, আমার বাবা এখন আমাদের দেখতে পাচ্ছেন। আমি জানি যে আমরা কত দূর এসেছি, তা নিয়ে তিনি কতটা গর্বিত হতেন। আমি জানি, তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেবেন যে আরও কাজ করতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের অদম্য চেতনাই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাঁর সকল স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেব না।’