চালকদের সুযোগ-সুবিধা কমানোয় ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩০ এএম, ২২ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৪৫ পিএম, ১৩ অক্টোবর,রবিবার,২০২৪
রেলের চাকা সচল রাখতে একজন চালককে দিনে গড়ে ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা ট্রেন চালাতে হয়। এজন্য তাদের বাড়তি মজুরি ও পেনশনে ৭৫ শতাংশ টাকা দেয়া হয়। বেতনের বাইরেও যত মাইল দায়িত্ব পালন করেন এবং অতিরিক্ত সময় কাজ করেন, তার জন্য নির্দিষ্ট হারে ভাতা পেয়ে থাকেন তারা। এটা রেলে ‘মাইলেজ ভাতা’ হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি রেলের অতিরিক্ত এ সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে ক্ষুব্ধ রেল চালকরা ২৬ ডিসেম্বর থেকে আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ কারণে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, সার্বক্ষণিক হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রিটিশ আমল থেকে চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালন করা চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়। অতিরিক্ত সময়ে প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে দেয়া হয় মূল বেতনের একদিনের সমপরিমাণ টাকা। পেনশনের সঙ্গে দেয়া হয় বাড়তি ৭৫ শতাংশ টাকা। এসব চালক ও গার্ডদের বেতন-ভাতা দেয়া হতো রেলওয়ের স্বতন্ত্র কাঠামোয়। কিন্তু গত ৩ ডিসেম্বর সফটওয়্যার ‘আইবাস প্লাস প্লাস’র মাধ্যমে রেলের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের (রানিং স্টাফ) আগের সেই ‘মাইলেজ’ সুবিধা থাকছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্ত জানার পর মাইলেজ সুবিধা চালুর দাবিতে নিয়মিত বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা করছেন চালক, গার্ড (ট্রেন পরিচালক) ও টিকিট চেকারেরা। তারা রেলমন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়ার পাশাপাশি একাধিক সভাও করেছেন। আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি না মানলে পরদিন থেকে কর্মঘণ্টার বাইরে কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। জানতে চাইলে রেলওয়ের রানিং স্টাফ (চালক-গার্ড) ও শ্রমিক-কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ১৬২ বছর ধরে ওই নিয়মনীতি অনুযায়ী বেতন-ভাতা নিচ্ছেন রেলওয়ের কর্মীরা। আগে প্রতি মাসে যেখানে রানিং স্টাফরা ১১ হাজার মাইল পেতেন। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ‘আইবাস প্লাস প্লাস’ সিস্টেমে মাইলেজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তিন হাজার মাইলের বেশি দেয়া যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিন হাজার মাইলের বেশি ট্রেন চালালেও তারা বেশি মাইলের জন্য কোনো ভাতা পাবেন না। এ প্রজ্ঞাপন রেলওয়ে আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের দাবি রেলওয়ের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী বেতন-ভাতা দিতে হবে। অন্যথায় ২৬ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার আন্দোলন চলবে। এতে ট্রেন চলাচল সমস্যা হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে, বলেন মুজিবুর রহমান।
রেলওয়ে আইনের ১৬৮৫/১০৮৫ বিধি অনুযায়ী, ট্রেন চালক, গার্ড ও ট্রেন টিকিট পরীক্ষকরা (টিটিই) রানিং স্টাফ। তারা নির্ধারিত ডিউটির পাশাপাশি কর্মরত অবস্থায় যত দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেন চালাবেন, সে হিসাবে মাইল গুণে বাড়তি ভাতা পাবেন। রেলওয়ে আইনে সাপ্তাহিক বা সরকারি বন্ধের দিনে ডিউটি করলে হলিডে মাইলেজ প্রাপ্তির বিধানও রয়েছে তাদের। ১৬২ বছর আগে থেকে এ বিধান চলে আসছে। এছাড়া ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর এক অনুশাসনে তাদের মাইলেজ (রেলের আইন অনুযায়ী) পাওয়ার কথা বলা রয়েছে। আগের নিয়মে রেলওয়ের স্বতন্ত্র কাঠামোতে বেতনের দাবিতে গতকাল সোমবার (২০ ডিসেম্বর) রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম) ও পন্ডিমাঞ্চলে (রাজশাহী) বিক্ষোভ করেছেন ট্রেন চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারেরা। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় গার্ড কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ট্রেন চালানোর পরও ঈদ-পূজার ছুটির সময় রানিং স্টাফদের ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয়। সেই বিবেচনায় ব্রিটিশ আমল থেকেই রানিং স্টাফরা মাইলেজ ভাতা পান। কারণ, রেলওয়ে রানিং স্টাফদের কোনো ছুটি নেই। চাইলেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন না তারা। একটু বেশি বেতনের আশায় সবাই নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালনের চেষ্টা করেন। এ প্রথা রেলওয়ের দেড়শ বছরের পুরোনো। বুধবার বেলা ১১টায় রেলভবনে রানিং কর্মচারী স্টাফ প্রতিনিধি ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স বিষয়ে আলােচনায় বসবেন রেলওয়ের যুগ্ম-মহাপরিচালক (মেকানিক) মৃণাল কান্তি বণিক। এই আলোচনা সভায় সমাধান আসবে বলে মনে করেন রেলওয়ের ওই কর্মীরা।
অবশ্য গত রোববার (১৯ ডিসেম্বর) এক চিঠিতে বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন রেলওয়ের উপ-সচিব সালমা পারভীনও। ওই চিঠিতে বলা হয়, সরকারের একটি বিশেষায়িত সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে, যা দেড়শ বছরেরও অধিক সময় ধরে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষায়িত এ প্রতিষ্ঠানটি রেলওয়ে অ্যাক্ট, সংস্থাপন কোড, জিএস রুলস, বিভিন্ন বিভাগভিত্তিক কোড-ম্যানুয়ালের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে যা ব্রিটিশ-ভারত থেকে পরবর্তীকালে পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ আমলেও কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং কর্মচারীরা দীর্ঘকাল ধরে রেলওয়ের এই প্রচলিত কোড ও অন্যান্য বিধিবিধানের আলোকে রানিং ভাতা এবং পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা ভোগ করে আসছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে রানিং কর্মচারীদের এই প্রাপ্য সুবিধাদি বেশকিছু ক্ষেত্রে রহিত করা হয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিয়ে দেয়া হয়েছে; যা বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রচলিত বিধিবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের সংস্থাপন কোড ভলিউম-১ এর ধারা ৫০৯ অনুযায়ী রানিং স্টাফরা প্রতি ১০০ মাইল বা আট ঘণ্টা ট্রেনে কাজ করার জন্য রানিং ভাতা প্রাপ্য হন। এক্ষেত্রে একজন রানিং কর্মচারী মাসে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ অর্থাৎ মাইলেজ/রানিং ভাতা প্রাপ্য হবেন তার কোনো সীমারেখা উল্লেখ করা নেই। তাই রেলওয়ের বিদ্যমান বিধিবিধানের আলােকে রানিং স্টাফদের দীর্ঘদিনের প্রচলিত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরােধ করা হলো। জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে রেলওয়ের স্বতন্ত্র কাঠামোতে কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ট্রেন চালকসহ সংশ্লিষ্টরা ক্ষুব্ধ। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আশা করি শিগগির এ সমস্যার সমাধান হবে।