যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ওপর জোর দিচ্ছে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনার দরজা খোলা : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২৮ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:৪১ এএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর জোর দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তিরক্ষা ও গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের একসাথে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনার দরজা খোলা থাকবে। নিষেধাজ্ঞাটা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের আইন প্রণেতাদের কারণে আরোপ করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আজ রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন একাধিক প্রশ্নের জবাবে এ সব কথা বলেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সফরের ওপর আলোকপাত করতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও সাংবাদিকদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল আগের রাতে (বুধবার) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ড. মোমেনের ফোনালাপ। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র গত শুক্রবার প্রতিষ্ঠান হিসাবে র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন রয়েছেন।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নিড প্রাইস এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। ব্লিঙ্কেন উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানবাধিকারের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন এবং বিশ্বের অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছেন।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ফোনালাপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ড. মোমেন বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে উষ্ণ পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তিনি আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমি বললাম, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের ৫০ বছরের বিশ্বস্ত বন্ধুত্ব রয়েছে। আমরা দুই দেশ সব ব্যাপারে আলোচনা করি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সমস্যা বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করে থাকে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের আগে থেকে জানানো হবে- এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। কিন্তু কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তটা আমরা পছন্দ করি নাই।
ড. মোমেন জানান, আমি অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনকে বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ, মাদকপাচার, মানবপাচারসহ নানাবিধ অপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াই করছে। বাংলাদেশের যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। র্যাব যুক্তরাষ্ট্রের এই লক্ষ্যগুলোই বাংলাদেশে বাস্তবায়নের জন্য যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। র্যাবের তৎপরতার কারণেই হোলি আর্টিসানের পর বাংলাদেশের বড় ধরনের কোনো জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, র্যাব দুর্নীতিপরায়ণ না। আর এ জন্যই র্যাবের ওপর বাংলাদেশের জনগণের আস্থা রয়েছে। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশবাসী পছন্দ করেনি। জবাবে অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বললেন, এটা নিয়ে আমাদের আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে।
জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় র্যাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ছয় লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ‘দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে’ প্রতি বছর হাজারখানেক মানুষ পুলিশের হাতে নিহত হয়। আর আমাদের দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে মানুষ মারা গেলে তাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড’ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে একই কাজ হলে তাকে বলা হয় ‘ইন দ্য লাইন অব ডিউটি’।
ড. মোমেন বলেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মানবাধিকার সমুন্নত রাখাকে আমাদের সরকার গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। এ সব ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকার কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত সংলাপ করে থাকে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমস্যা থাকলে এসব সংলাপেই তা বলা যেত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কোনো সমস্যা থাকলে ভবিষ্যতে আমাকে সরাসরি টেলিফোন করার জন্য অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনকে অনুরোধ করেছি। ব্লিঙ্কেনও একইভাবে তাকে টেলিফোন করার জন্য আমাকে আহ্বান জানিয়েছেন। আমি দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত সংলাপগুলো আবারো শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছি, যাতে দ্বিপক্ষীয় কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। আমি শিগগিরই সরাসরি দেখা করে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তার এই মনোভাব আমার ভালো লেগেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোমেন বলেন, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ফোনালাপ হয়েছে। তবে এতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়নি। ব্লিঙ্কেন এ ব্যাপারে আলোচনা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আগামী বসন্তে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা হতে পারে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সাথে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইস্যুভিত্তিক আলোচনা হয়নি। তবে সার্বিকভাবে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতির সফরে মূলত আনুষ্ঠানিকতার ওপর নজর দেয়া হয়েছে। তবে অনিষ্পন্ন কোনো ইস্যু থাকলে ভারতের রাষ্ট্রপতি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ একমত হয়েছেন, দুই দেশ এমন কিছু করবে না যাতে কারো জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর পাশাপাশি কানেক্টিভিটির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ যেভাবে কাজ করেছে, সে জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের দেশে সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই। এখানে সবাই বাঙালি, সবাই সমান। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উক্তি ভারতে বেশ সাড়া ফেলেছে বলে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশে আসা একজন পার্লামেন্ট সদস্য মন্তব্য করেছেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।