রোহিঙ্গা বসতিতে কোণঠাসা পরিবেশ, ৮ হাজার একর বন উজাড়, ক্ষতি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:১১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ১১:৩৮ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজার জেলার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য বলতে গেলে ধ্বংস হতে চলেছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এ জনগোষ্ঠী জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চলের ৮ হাজার ১ দশমিক ২ একর বন উজাড় করে বসতি স্থাপন করেছে, ব্যবহার করেছে জ্বালানি হিসেবেও। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকারও বেশি। বনবিভাগের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তবে সংসদীয় কমিটির দাবি, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। কমিটির মতে, ক্ষতি প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। বিশদ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পাহাড় কাটা চলছে অবাধে
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৮ম সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসতে থাকে। এখন ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। পুরনো দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্প এবং নতুন অনিবন্ধিত ৩২টি ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩৪টি। ৬ হাজার ১৬৪ দশমিক ০২ একর বনভূমি দখল করে এসব ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, ভূমিরূপ পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়েছে।
জ্বালানির জন্য বন থেকে লাকড়ি কেটে আনছে রোহিঙ্গারা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি টাকার অঙ্কে প্রায় ৪৫৭ কোটি টাকা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
এতে আরও বলা হয়, ৫৮০ একর সৃজিত বন এবং এক হাজার ২৫৭ একর প্রাকৃতিক বনসহ ক্যাম্প এলাকার বাইরে জ্বালানি সংগ্রহে রোহিঙ্গারা বনাঞ্চল উজাড় করেছে এক হাজার ৮৩৫ একর। সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ৮০০১ দশমিক ০২ একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে সে সম্পর্কিত আরও বিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য বনবিজ্ঞানের অধ্যাপককে আহবায়ক এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে (কক্সবাজার) সদস্য সচিব করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পাহাড় কাটা চলছে অবাধে
জানা গেছে, গত ১৭ অক্টোবর সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী কমিটির ৪ সদস্যকে নিয়ে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে পরিবেশ, বন ও জীববৈচিত্র্যে যে প্রভাব পড়ছে তা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় তারা দেখতে পান, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের ৮ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বনবিভাগ জানিয়েছে, ধ্বংস হওয়া বনজ সম্পদের আর্থিক ক্ষতি ২ হাজার ৪২০ দশমিক ৬৭ কোটি টাকা।
নেমেছে পানির স্তর
বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে এ পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি টিউবওয়েল স্থাপন করতে হয়েছে। এ কারণে পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নামছে। ওই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত পানির ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। এ জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের পাশাপাশি পরবর্তী ক্ষতি রোধের উপায় এবং কতটুকু ক্ষতি পুষিয়ে আনা যাবে এবং এ উদ্দেশ্যে কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, একটি গাছ তার শেকড়ের সঙ্গে পানি ধরে রাখে। এর কারণে ভূ-পৃষ্ঠের পানির স্তর উপরের দিকে থাকে। যখন গাছটি মরে যায় বা যেখানে গাছ থাকে না সেখানে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। কক্সবাজারে অতিরিক্ত টিউবওয়েলের কারণে যেমন পানির স্তর নিচে নামছে, বন উজাড়ের কারণেও স্তর নেমে যাচ্ছে। এটা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।
পাহাড় কাটা চলছে অবাধে
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমরা স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে একটা গবেষণা করেছি। তাতে দেখা গেছে, যখন ব্যাপক হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসতে শুরু করে তখন প্রথম তিন মাসেই কক্সবাজারের বনাঞ্চলের ১১ ভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে এক দিনে যেমন মানুষ বেড়েছে তার সঙ্গে তাদের নিঃসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও বেড়েছে। অপরদিকে গাছ কাটার মাধ্যমে কার্বন শোষণের ‘প্রাকৃতিক মেশিন’ বন্ধ হয়ে গেল। দুই দিক থেকেই ক্ষতি হয়েছে। এখন দ্বিগুণ হারে সেখানে কার্বন জমছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বন বিভাগ তো তাদের নিজস্ব একটা পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণের তালিকা তৈরি করেছে। তাতে দেখা গেছে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা বলেছি এর বিশদ রিপোর্ট তৈরি করতে। কীভাবে ক্ষতির মাত্রাটা নির্ধারণ করা হবে সে জন্য রিপোর্টের একটা ভিত্তি, ক্যাটাগরি বা মডেল থাকতে হবে। এজন্য একটা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে তারা প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে। প্রাথমিকভাবে আমরা যেটা দেখেছি, বনগুলো উজাড় ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে।
জ্বালানির জন্য বন থেকে লাকড়ি কেটে আনছে রোহিঙ্গারা
একই কমিটির সদস্য ও বগুড়া-৭ আসনের সংসদ সদস্য মো. রেজাউল করিম বাবুল বলেন, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার আগ পর্যন্ত হাতির করিডোর সৃষ্টি করে উক্ত এলাকা খালি করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। এটা বাস্তবায়ন করা না গেলে হাতি বাঁচানো যাবে না।
কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য বেগম খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে বনভূমি থেকে জ্বালানি সংগ্রহ; পাহাড় ও গাছ কাটা, অল্প স্থানে অধিক মানুষ বসবাসের কারণে জনখাদ্যের হুমকিসহ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাহাড় ধসের আশঙ্কা বৃদ্ধি, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কাও রয়েছে।
সভায় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পর ওই এলাকাগুলো যেন আবার দখল না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কমিটির সদস্য মো. রেজাউল করিম বাবলু বলেন, স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের কারণে কোণঠাসা অবস্থায় আছে। রোহিঙ্গাদের অন্য কোথাও স্থানান্তর করা যায় কি না ভাবতে হবে।
কমিটির অপর সদস্য ও কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, বাঁধ নির্মাণ করে প্রাকৃতিক পানি ব্যবহারের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। পাশাপাশি বনায়ন ও মহেশখালীতে যেসব চর জেগেছে সেগুলোকেও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প হুমকিতে হাতি
রোহিঙ্গাদের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় বন্যপ্রাণীরাও। বিশেষ করে বিপদে পড়েছে হাতি। বনবিভাগ জানিয়েছে, কক্সবাজারের বনাঞ্চলে ৬৩টি হাতি রয়েছে। এসব হাতির চলাচলের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে ৩টি করিডোর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে তুলাবাগান-পানেরছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল ও উখিয়া-ঘুনধুম। রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের কারণে এরই মধ্যে উখিয়া-ঘুনধুম করিডোরটি বন্ধ হয়ে গেছে। এ এলাকায় হাতি-মানুষ সংঘাতে এ পর্যন্ত ১২ জন মানুষ মারা গেছে। বাকি দুটি করিডোরও প্রায় বন্ধের মুখে।
বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন। গত ১০ নভেম্বর তার কাছে প্রশ্নগুলো পাঠানো হয়। প্রশ্নগুলোর মধ্যে ছিল- ‘সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারে ৮ হাজার একর বন ধ্বংস করেছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের বন ও পরিবেশের মানোন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের কী কী পদক্ষেপ রয়েছে?’ এখন পর্যন্ত তার উত্তর পাওয়া যায়নি।