কর্মস্থলে ফিরতে মরিয়া মানুষ, পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:৪১ পিএম, ১ আগস্ট,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:৫৭ পিএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
আজ খুলছে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে গতকাল শনিবার দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ কর্মস্থলে যোগ দিতে ঢাকায় ফিরেছেন। আর সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যে রাজধানীতে ফেরা মানুষকে পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি। সেই সঙ্গে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।
দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রবেশপথ ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজ, গাবতলী, আমিনবাজার, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় এ চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, রিকশা ও পিকআপ ভ্যানে করে মানুষ রাজধানীতে ঢুকছে। দলে দলে হেঁটেও ঢাকায় ঢুকছে মানুষ। সর্বত্রই গিজগিজ করছে মানুষ।
রাজধানী শহর ঢাকার দিকে ছুটে চলা এসব মানুষের মাথায়, ঘাড়ে ও হাতে বড় বড় ব্যাগ আর চোখে-মুখে অবর্ণনীয় ভোগান্তির ছাপ। আছে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ও।
ঢাকায় ঢোকার জন্য তারা পাঁচ/ছয় বার যানবাহন বদলেছে। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যাটা দশের অধিকও। হুট করে ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা আসার পর থেকেই পায়ে হেঁটে ঢাকায় ঢোকা মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ।
আব্দুর রাজ্জাক নামে একজন বলেন, ‘গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর থেকে ঢাকায় ফিরলাম। সরকার যে লকডাউন দিয়েছে তা পালন হলো কোথায়? আমরা যারা গার্মেন্টসে বা কারখানায় চাকরি করি আমাদের বলা হয়েছিল আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউন থাকবে। আর ততদিন আমাদের অফিসও (গার্মেন্টস) বন্ধ থাকবে। কিন্তু লকডাউন শেষের আগেই গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো। সাধারণ শ্রমিকরা কীভাবে ফিরবে? সেটা সরকার চিন্তা করল না। শ্রমিকদের সঙ্গে এটা একটা প্রহসনই হলো।’
এদিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের যাতায়াতের সুবিদার্থে গতকাল রাত থেকেই সারাদেশে গণপরিবহন চালু হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি জানান, এক দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচল করবে।
ঢাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করার দাবিতে রংপুর নগরীর মডার্ন মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার পোশাকশ্রমিক। গতকাল সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত পরিবহন না পেয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
অবরোধের কারণে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেখানে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ শ্রমিকদের কোনোভাবেই বুঝাতে পারছিলেন না। অবশেষে পুলিশ ঢাকা থেকে ঈদের আগে রংপুরে আসা দোতলা বিআরটিসি বাসে শ্রমিকদের যাতায়াতের বন্দোবস্ত করে দিলে বিকাল সাড়ে ৩টা নাগাদ তারা অবরোধ তুলে নেন।
শ্রমিকদের পরিবহনের জন্য যাত্রীবাহী লঞ্চ আজ রবিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। গতকাল রাতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জনসংযোগ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, শ্রমিকদের যাতায়াতের কথা বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে রবিবার (আজ) ১২টা পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। এরপর নৌযান চলাচল করতে পারবে কি না, তা ঐ সময় বলা যাবে।
মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে ঢাকামুখী যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। করোনার কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে লঞ্চ ও স্পিডবোট বন্ধ থাকায় মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে ফেরিতে চড়ে শিমুলিয়া ঘাটে আসছেন যাত্রীরা। বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছেড়ে আসা ফেরিতে গাড়ির তুলনায় মানুষই বেশি আসছেন।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম মো. জিল্লুর রহমান জানান, পাটুরিয়া নৌ-রুটে ছোট-বড় আটটি ও আরিচা ফেরিঘাটে তিনটি চলাচল করে। জরুরি পণ্যবাহী গাড়ি পারের সময় হাজার হাজার লোকজন হুমড়ি খেয়ে ফেরিতে উঠে পড়ছেন। অনেক ফেরি বাধ্য হয়ে শুধু যাত্রী নিয়ে ছেড়ে আসছে।
অপর দিকে ভোলার ইলিশাঘাটে উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। শত ভোগান্তি মাথায় নিয়ে চাকরি বাঁচাতে ভোলার ইলিশা-লক্ষ্মীপুর রুটের ফেরিতে কর্মস্থলে ফিরছেন হাজার হাজার শ্রমিক।
গতকাল ভোর থেকে নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়া বাইপাস মোড়ে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এ সময় ট্রাক, পিকআপসহ সব ধরনের যান পরম আরাধ্য হয়ে উঠে। পেলেই তাতে হুমড়ি খেয়ে উঠছেন সবাই। চাকরি হারানোর ভয় ও অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তারা ছুটছেন রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের শিল্পাঞ্চল জেলাগুলোয়।
যানবাহনের প্রকারভেদে বনপাড়া থেকে গাজীপুর বাইপাল ও চন্দ্রা পর্যন্ত ভাড়া জনপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকা ও সর্বনিম্ন ৮০০ টাকা রাখা হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সরকারি এই সিদ্ধান্তের ফলে কর্মস্থলে ফিরতে কর্মজীবীরা যেমন গুনছেন মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, তেমনই পোহাচ্ছেন দুর্ভোগ। একটি ট্রাকে উঠেছেন প্রায় ৭০ জন যাত্রী। তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার দিকে বিন্দুমাত্র নজর ছিল না কারোরই।
পণ্যের গাড়ি আনছে শ্রমিক: নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ওসি জানালেন, পণ্যবাহী যানে আসা শ্রমিকদের চেকপোস্টে থামানো হচ্ছে। তবে রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে আসা শ্রমিকদের যেতে দেওয়া হয়েছে। কারখানা খুলেছে, কাজে যোগ দেবেন বলে তাদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে।
শ্রমিকদের ঢল গাজীপুরের দুই মহাসড়কেও: ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহসড়কে শনিবার সকাল থেকে হেঁটে, রিকশা ভ্যানে, মোটরসাইকেলে, পিকআপ ও ট্রাকে করে ফিরতে দেখা গেছে তাদের। মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি কামাল হোসেন বলেন, সকাল থেকে মহাসড়কে প্রচণ্ড ভিড়। বেশির ভাগ যাত্রী হেঁটে ও রিকশায় চলাচল করছেন। আমরা তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সচেতনতামূলক মাইকিং করছি।
শ্রমিকনেতারা বলছেন, হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের ভোগান্তিতে ফেলেছে। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন জান্নাতী খাতুন। ঈদ ও শাটডাউনের কারণে এতদিন ছিলেন সিরাজগঞ্জে নিজ বাড়িতে। শুক্রবার শুনলেন রবিবার থেকে খোলা কারখানা। বাধ্য হয়ে ঢাকা ফিরতে গতকাল শনিবার ভোরে ছেলেকে নিয়ে রওনা দিয়েছেন। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হাইওয়েতে শনিবার সকালে একটি ট্রাকে পাওয়া যায় তাকে। বৃষ্টিতে ভিজেই ফিরছেন তিনি।
শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে সব ধরনের গণপরিবহন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার রাতে সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের কাজে যোগদানের সুবিধার্থে ১ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ঢাকামুখী যাত্রীদের পরিবহনের জন্য আজ সারা দিন সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল করবে। গতকাল সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কয়টা পর্যন্ত বাস চলাচল করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সারা দিন চালু রাখব। প্রয়োজন হলে রাত অবধি চালু রাখতে পারি।
বাস-লঞ্চ চললেও ট্রেন চালানো সম্ভবপর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি গতকাল শনিবার রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, স্বল্প সময়ের জন্য রেল চলাচল সম্ভব না। রেল চলাচল শুরু করতে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, হঠাত্ করে শুরু করা যায় না। ফলে রেল চলাচল করবে না।