ঋতু, রুপনা, মনিকা হয়ে জ্বলে উঠার পেছনের গল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২১ পিএম, ১১ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:১৪ এএম, ১৩ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বীরসেন চাকমা। নামটি বলতেই বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন মনিকা চাকমা। কণ্ঠ যেন কিছুটা কেঁপে উঠলো, ‘আমি আজকে যে এই জায়গায়, এই যে দেশের হয়ে খেলছি, এর পেছনে বড় অবদান বীরসেন স্যারের। তিনিই আমার মধ্যে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা বুনে দিয়েছিলেন।’
শুধু মনিকা কেন, সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের দুই সেরা তারকা ঋতুপর্ণা চাকমা আর রুপনা চাকমাদেরও আবিষ্কার করেছেন রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার মগাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা। মনিকা এসেছেন খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা থেকে। সেই ২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল উৎসব দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছিল উৎসবের মতো করে। জেলা পর্যায়ের শিক্ষা অফিস থেকে স্কুলে স্কুলে নির্দেশনা গিয়েছিল খুদে ফুটবলারদের দল তৈরি করে বঙ্গমাতা কাপে অংশগ্রহণের। ফুটবলপ্রেমী বীরসেন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুদে ফুটবলারদের বাছাই করে তৈরি করলেন মগাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দল। শুরুতে ঘাম ছুটে গিয়েছিল খুদে ফুটবলারদের তৈরি করতে। কিন্তু সেই দলটাই জাতীয় পর্যায়ে শিরোপা জিতল। ঋতু, মনিকা, রুপনাদের পেয়ে গেল বাংলাদেশ।
তবে তাঁদের ঘষেমেজে রত্নে রূপ দেওয়ার কাজটা করলেন স্থানীয় পর্যায়ের কোচরা। রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার তখনকার সাধারণ সম্পাদক বরুণ বিকাশ দেওয়ান দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন। আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধার জার্সিতে গোটা নব্বইয়ের দশকে ঢাকার ফুটবলে বরুণ দেওয়ান মানেই বড় নাম। জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে জিতেছিলেন চারজাতি টুর্নামেন্টের শিরোপা। ঋতু, রুপনা, মনিকাদের ঘষেমেজে তৈরি করার কাজটা কোচ হিসেবে করলেন তিনি আর তাঁর বড় ভাই অরুণ বিকাশ দেওয়ান। অরুণ দেওয়ানকেও চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ফুটবলপ্রেমীদের। আবাহনী, মোহামেডানে খেলেননি, তবে মুক্তিযোদ্ধায় খেলেছেন এই গোলকিপার। জাতীয় দলের হয়েও কয়েকটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। নব্বইয়ের দশকে ঢাকার ফুটবলে মাঝারি শক্তির দলগুলোর বড় তারকাই ছিলেন অরুণ। ছোট ভাই বরুণের সঙ্গে তিনিও খুদে ফুটবলারদের হাতে ধরে দিয়েছিলেন পাঠ। কিন্তু বীরসেন বলুন, কিংবা বরুণ অথবা অরুণ দেওয়ান বলুন, তাঁরা কি সে সময় কেউ ভেবেছিলেন, তাঁদের হাতে গড়া সেই খুদেরাই একসময় সারা দেশ মাতাবে! দেশের দক্ষিণ এশীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে রাখবেন বড় ভূমিকা! কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জেতার দিন তাঁদেরই ছাত্রী ঋতুপর্ণা হলেন সেরা খেলোয়াড়, রুপনা হলেন সেরা গোলকিপার। আর মনিকা তো হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলেরই প্রাণভোমরা।
রাঙামাটির মগাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমার বাড়ির পাশেই ছিল ঋতুপর্ণা চাকমাদের বাড়ি। ঋতুকে তিনিই ভর্তি করেছিলেন মগাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ঋতু যে ছোটবেলা থেকেই প্রতিভা দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন, সেটি জানালেন তিনি, ‘আমি ২০১১ সালে আমার স্কুলের দল তৈরি করে জাতীয় পর্যায়ে শিরোপা জিতেছিলাম। ২০১২ সালে ঋতু আসে দলে। খুব লাজুক একটা মেয়ে। বলে লাথি দিতে চাইত না। কিন্তু যখন দিত দুই পায়েই সমানভাবে দিত। ওর প্রতিভা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ ছিলাম। সেই মেয়েটিই এখন জাতীয় দলে খেলে, দেশকে শিরোপা জেতায়—ভাবলে নিজেকে বেশ তৃপ্ত মনে হয়।’
রুপনা তাঁর স্কুলেই পড়তেন। মনিকাকে তিনি তুলে আনেন খাগড়াছড়ি থেকে। শুধু ঋতু, মনিকা, রুপনারাই নন, তিনি খাগড়াছড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন দুই বোন আনাই মোগিনি আর আনুচিং মোগিনিদের। তাঁর একটা জেদ ছিল এই প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের তিনি জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু তিনি তো আর ফুটবলের টেকনিক্যাল ব্যাপারটা জানেন না। তখন তিনি শরণাপন্ন হন বরুণ আর অরুণ দেওয়ানের, ‘বরুণ বিকাশ দেওয়ান আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলেছেন, তাঁর ভাই অরুণও। ওনারা রাঙামাটিতে কোচ হিসেবে কাজ করেন। আমি আমার মেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের কাছে যাই। ওনারা সানন্দে রাজি হন। একটা পয়সাও পারিশ্রমিক নেননি। ঘষেমেজে তৈরি করেছেন। ঋতু, মনিকা, রুপনা, আনাই, আনুচিংদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হয়েছে তাঁদের হাত ধরেই।’
বরুণ বিকাশ দেওয়ানের খুব মনে আছে ঋতু, মনিকা, রুপনাদের ছোটবেলা, ‘আমি যখন ঋতুকে প্রথম দেখি, তখন সে ক্লাস টুর ছোট্ট একটা মেয়ে। খুব লাজুক। কিছু বললে লজ্জা পেত, ভয়ও পেত। শিশুর মতো ওদের সঙ্গে মিশেছি। ওদের খেলা শিখিয়েছি। তবে আমার চেয়েও বেশি কাজ করেছেন আমার বড় ভাই অরুণ দা। রুপনা তো তাঁর হাতেই তৈরি। মনিকাও ছোটবেলা থেকে খুবই প্রতিভাবান। আজ খুব ভালো লাগছে ওদের সাফল্য। নিজেদের পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।’
মনিকা চাকমা নিজেও বলেছেন, শুরুতে ফুটবল কীভাবে খেলতে হয়, সেটাই নাকি তাঁরা জানতেন না, ‘আমরা তো তখন খুবই ছোট। স্যাররাই আমাদের ধরে ধরে শিখিয়েছেন। আমাদের খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার মরাচেঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন স্যার ছিলেন—গোপাল স্যার। তিনি শিখিয়েছিলেন বৃষ্টিভেজা মাঠে বলের কোথায় লাথি দিতে হয়। এরপর বীরসেন স্যার স্বপ্ন বুনে দিলেন। বরুণ, অরুণ স্যাররা ফুটবলের আসল পাঠটা দিয়েছেন আমাদের।’
দিনকাল/এসএস