বিদায় টেনিসের রাজা রজার ফেদেরার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:৪৮ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৩৭ পিএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
"যেতে নাহি দিবো হায়, তবুও যেতে দিতে হয়...", রাফায়েল নাদাল যদি বাংলা জানতেন তাইলে রবীন্দ্রনাথের লিখে যাওয়া এই চরণের মর্মার্থ খোজার চেষ্টা করতেন জানপ্রাণ দিয়ে। টেনিস কোর্টে যে মানুষটা ছিলো সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী, যার সামনে না পড়লে নাদাল হয়তো জিততে পারতেন আরো গোটা দশ-বারো গ্র্যান্ড স্লাম, সেই প্রতিপক্ষের বিদায়ক্ষণে নাদাল যেভাবে চোখের অশ্রু ঝরিয়েছেন সেটি দেখলে মনে হবে কত আপন, কত কাছের বন্ধুর বিদায়বেলা ।
হ্যা, আসলেও বন্ধু। কোর্টের চরম শত্রু, কোর্টের বাইরে টেনিসের রাজা রজার ফেদেরারের সঙ্গে নাদালের বন্ধুত্ব ছিলো বেশ জম্পেশ। দুজনের কোর্টের লড়াইটা বরং উপকারেই এসেছে দুজনের, প্রতিনিয়ত একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না, যেই তাড়না থেকে দর্শকরা উপহার পেয়েছে টেনিসের দুই কিংবদন্তিকে।
যেই কোর্টে এতো গল্প, সেই টেনিস কোর্টে শেষবারের মতো র্যাকেট হাতে দাড়ালেন ফেদেরার। ইশ্বরের কারসাজিই কিনা, জীবনের শেষ খেলায় ফেদেরারের সঙ্গী তার আজীবনের শত্রু সেই নাদাল।
লন্ডনের ও২ অ্যারেনায় লেভার কাপের শেষ ম্যাচ ছিলো মেনস ডাবলস। সেই ম্যাচেই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রজার ফেদেরার আর রাফায়েল নাদাল জুটি বেধে নেমেছিলেন কোর্টে। ফেদেরারের জন্য শেষবার কোর্টে নামা। ম্যাচশেষে আঝোরে চোখের পানি ঝরিয়েছেন ফেদেরার। পানি ঝরাতে বাধ্য করেছেন অ্যারেনার দর্শকদের। আর রাফায়েল নাদাল? তার জন্য যেন ভাই হারা শোকের কান্না।
নাদাল-ফেদেরার লড়াইয়ের মাঝে হঠাৎ এসে অভাগ বসানো নাম ছিলো নোভাক জোকোভিচ। ‘জোকার’ ডাকনামে পরিচি নোভাক জোকোভিচ আড়ালে মুছেছেন চোখের অশ্রু। বিদায় বেলায় কোর্টে নামার আগে ফেদেরার পাশে পেয়েছেন বিশ্ব টেনিসের বিগ ফোরের আরেক সদস্য অ্যান্ডি মারেকেও। এর চেয়ে ভালো বিদায় যেন আশা করতে পারেন না কেউই।
বিদায়বেলায় এমন পরিবেশ পেয়ে নাকি তাই বেশ আনন্দিত ফেদেরার নিজে। অঝোরে ঝরতে থাকা চোখের অশ্রুকে বললেন "আনন্দাশ্রু"। আসলেই কি তাই? নিজের হাতের চেয়েও হয়তো প্রিয় ছিলো যেই টেনিস র্যাকেট সেটাতে আর আজ থেকে হাত দিবেন না, নিজের ঘরের চেয়েও আপন টেনিস কোর্টে আজ থেকে আর নামা হবে না। ফেদেরারের চোখ থেকে পানি ঝরছিলো ঠিক যেন বাচ্চাদের মতো। বারবার চেস্টা করেছেন চখের পানি মুছে স্বাভাবিক হতে। কিন্তু আপন নীড় ছাড়ার বেদনা কি থামানো যায়?
বেদনার রঙ নাকি নীল? এই কথাটা কতখানি সত্য সেটা প্রমাণ করা তর্ক সাপেক্ষ, তবে টেনিসের রাজার বিদায়ের দিন ও২ অ্যারেনা আর ফেদেরারের দল ইউরোপ সেজেছিলো সেই নীল রঙেই। ফেদেরার যদিও জীবনের শেষ ম্যাচ পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, এই অশ্রু বেদনার নয়, এটি আনন্দের।
ফেদেরার বলেন, ‘এই অশ্রু আসলে আনন্দের অশ্রু। আমি সুস্থ আছি, সুখে আছি, সবকিছু চলছে ভালোই। আপনি জানেন, জীবন তার নিজের গতিতেই বয়ে চলে!’
বিদায়ের নীল বেদনার সঙ্গেও ভক্তদের খুশি হয়ার মতো বার্তাও দিয়েছেন ফেডএক্স। বলেন, ‘এখানেই সবকিছুর শেষ নয়; জীবন জীবনের মতোই এগিয়ে চলবে। একটি বার্তা দিতে চাই, খেলাটির প্রতি আমার ভালোবাসা থাকবে। ভক্তদের জানাতে চাই, আবারও দেখা হবে, বিশ্বের অন্য কোথাও, আলাদা কোনো টেনিস কোর্টে। তবে কবে, কোথায়, কীভাবে হবে, তা নিয়ে এখনো কোনো পরিকল্পনা করিনি। এমন সব জায়গায় গিয়ে খেলতে চাই, যেখানে আগে কখনো খেলিনি। সামনের বছরগুলোয় শুধু ধন্যবাদ জানিয়ে যেতে চাই সবাইকে, যারা এত দিন ধরে আমাকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন।’
আর ম্যাচশেষে তার টেনিস কোর্টের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর জীবনের কোর্টের বন্ধু নাদাল বলেন, ‘আমাদের এই খেলার ইতিহাসে অনন্য এ মুহূর্তের সঙ্গী হতে পারাটা আমার জন্য বিশেষ সম্মানের। দুজনে একসঙ্গে কত বছর ধরে কত কিছু ভাগ করে নিয়েছি। ফেদেরারের চলে যাওয়া মানে আমার জীবন থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়েরও অবসান ঘটা।’
টেনিসে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তিই যেন টেনে দিল ফেদেরারের বিদায়। ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছেন ২০ গ্র্যান্ডস্লাম, নাদাল-জোকোভিচ পরে তাকে ছাড়িয়ে গেলেও পথটা তো দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই, এটিপি র্যাঙ্কিংয়ের চূড়ায় সবচেয়ে বেশি দিন থাকার রেকর্ড এখনও ফেডএক্সের নামেই। এতোসব রেকর্ড আর পরিসংখ্যান ছাপিয়েও সুইস তারকার পক্ষে কথা বলবে তার অনিন্দ্য সুন্দর সব শট, তার ফোরহ্যান্ড তো ছিলো যেন অন্য কোন গ্রহের নাম না জানা কোন ফুলের সৌরভ ছড়ানো উপাখ্যান।
আজীবন ভদ্রলোক হিসেবেই স্বীকৃত হয়ে আসা ফেদেরার জীবনের শেষ ম্যাচেও যেন সেই নিপাট ভদ্রলোক। ম্যাচশেষে জানালেন, ‘রাফার সঙ্গে একই দলে খেলা এবং অন্যদেরও কাছে পাওয়া, যেসব কিংবদন্তি এখানে আছে...ধন্যবাদ।'
বিদায় বেলায় পুরো কোর্ট ঘুরলেন, শেষবারের জন্যই হয়তো বা দর্শকদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করলেন খেলোয়াড় হিসেবে। তারপর, চিরদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ন্দাল-জোকোভিচের কাঁধে চড়েই বিদায় নিলেন কোর্ট থেকে। বিদায়বেলায় ফেদেরার যতই বলুক না কেন, তার অশ্রু আনন্দের, তবুও কোর্টে হাজির অন্যদের, ও২ অ্যারেনার গ্যালারিতে উপস্থিত ভক্ত সমর্থক থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় সব টেনিস ভক্তের মনে ছেয়ে গেছে কিংবদন্তির বিদায় বিষাদের বেদনার সুর।