ওপারের সংঘাতে এপারে আতঙ্ক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:১৭ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:৪৮ এএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে সংঘাতের জেরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নে তুমব্রু সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কয়েকমাস ধরেই মিয়ানমারে এ সংঘাত চলে এলেও শুক্রবার সীমান্তে জিরো লাইনে গোলার আঘাতে একজনের নিহতের ঘটনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে আতঙ্ক। নিরাপত্তার জন্য ৩৫টি পরিবার স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। পরিবর্তন করা হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রও। সর্তক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। আর সীমান্তে চলাচলে আরোপ করা হয়েছে বিধিনিষেধ। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিবদমান সংঘর্ষ বাড়ায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী আগ্রাসী অভিযান চালাচ্ছে। এর রেশ এবং উত্তেজনা পড়ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। টানা সংঘর্ষের ঘটনায় সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সীমান্ত এলাকার মানুষ বলছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রবিবারও গোলার বিকট শব্দ শোনা গেছে। আগের চেয়ে শুক্রবারের ঘটনার পর রোহিঙ্গারা আরও বেশি আতঙ্কিত। কিন্তু তারা এখনও শূন্যরেখায় অবস্থান করছেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। কয়েকমাস ধরেই মিয়ানমারে সংঘাত চলে এলেও শুক্রবার সীমান্তে জিরো লাইনে গোলার আঘাতে একজনের নিহতের ঘটনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে আতঙ্ক। ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা কোনারপাড়ার বাসিন্দা নুর হাসিনার। তার বাড়িতে শুক্রবার রাতে এসে পড়ে একটি মর্টার শেল, যা বিস্ফোরিত হয়নি। তবে তার বাড়ির কিছু দূরে আরও একটি মর্টার শেল পড়ে বিস্ফোরিত হয়। যার শব্দে কেঁদে ওঠে নুর হাসিনার ৪ মাসের কন্যা শিশু। এ আতঙ্কে তার পুরো পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে তুমব্রু মাঝেরপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। নুর হাসিনা জানান, মিয়ানমারে আগে থেকেই সংঘাত চলছে। এতদিন গোলার শব্দ শোনা যেত।
শুক্রবারের ঘটনার আগে ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ছোড়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। পরে ৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো আরও একটি মর্টারশেল এসে পড়ে বাংলাদেশে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপি আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১ এর মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নাইক্ষৎছড়ির তমব্রু সীমান্ত রেখায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা গত কয়েক বছর ধরে বসবাস করছে। সহিংসতার কারণে তারা বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। তা ছাড়া কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের সাথেও বৈঠক করে ঘটনাগুলো সম্পর্ক অবহিত করেছেন। ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, গেল এক মাসে চলা গোলাগুলিতে ভয়ে ছিল সীমান্তের বাসিন্দারা। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনায় এখন বেশ আতঙ্কিত সীমান্তের বাসিন্দারা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। সবাই সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়াও বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। টানা সংঘর্ষের ঘটনায় সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
তিনি আরও বলেন, শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সীমান্তে মিয়ানমারে অভ্যন্তরে গোলাগুলি, মর্টার শেল বিস্ফোরণ পর শনিবার সকালেও কয়েকটি গোলার বিকট শব্দ হয়েছে। আর শূন্যরেখায় মর্টার শেলের বিস্ফোরণে আহতরা এখনও উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় চলাচলে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, আগের চেয়ে শুক্রবারের ঘটনার পর রোহিঙ্গারা আরও বেশি আতঙ্কিত। কিন্তু তারা এখনও শূন্যরেখায় অবস্থান করছেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। গেল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সমস্যা হয়েছে মিয়ানমার সরকারকে নিয়ে। যে যত চাপই দিক এরা কোনো ব্যাপারই নেয় না। এরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত। এখানেই বড় সমস্যা। শুক্রবারের ঘটনার জেরে রবিবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদিন তাকে তলব করে কৌশলী উপায়ে নিজেদের বিরক্তি প্রকাশ করেছে ঢাকা। তলবে এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এলে রাষ্ট্রদূত মোয়েকে কোনো আপ্যায়ন করা হয়নি। এক কাপ চা পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতসহ সঙ্গে থাকা সঙ্গীকে দেয়া হয়নি। আধা ঘণ্টার কাছাকাছি সময় রাষ্ট্রদূত মো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নাজমুল হুদার দফতরে অবস্থান করেন। সীমান্তে গোলাগুলি, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও রোহিঙ্গা হতাহতের বিষয়টি তুলে ধরে ঢাকা। কূটনীতিক রীতি বা প্রথা অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি কূটনীতিকদের আপ্যায়ন করে থাকলেও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের খাবার-পানি কিছুই দেয়া হয়নি। পরে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদলিপি দিয়েছি। সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না হয় আমরা সেটা বলেছি। আরও বলেছি, এটি আপনাদের (মিয়ানমারের) অভ্যন্তরীণ বিষয়। কীভাবে সমাধান করবেন, তা মিয়ানমারকে চিন্তা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ধৈর্যের সঙ্গে অনেক দিন ধরে এসব সহ্য করে যাচ্ছি। আমরা তাদের বলেছি, আপনারা আপনাদের সমস্যা সমাধান করুন, যাতে আমাদের এখানে কোনো রক্তারক্তি না হয়, কোনো প্রাণ না যায়। সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যেকোনো ধরনের গোলার ব্যবহার করার আগে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের অবস্থান কী ছিল জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব জানান, তাদের উত্তর গতানুগতিক। তাদের দাবি, গোলাগুলি চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এসব তথ্য তিনি নেপিদোতে জানাবেন তাদের কর্তৃপক্ষকে, তারা যেন এ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
মিয়ানমারের কর্মকান্ডে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ভেতরের কাহিনীগুলো আপনাদের লক্ষ্য করতে হবে। তারা এগুলো যে করছে, তার ভেতরেই একটি কাহিনী আছে। আপনারা লক্ষ্য করুন, তাদের সীমানা পেরিয়ে আমাদের সীমানায় তাদের গোলাবারুদ আসছে। আমাদের এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যারা একদম জিরো লাইনে অবস্থান করছিল, ওই এলাকার ক্যাম্পের ভেতরে যে গোলাবারুদগুলো এসে পড়ে এর মধ্যে দুটো বিস্ফোরিত হয়েছে। এতে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছেন। আমাদের বিজিবি কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিপিকে। আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি, আমরা কোনো যুদ্ধ চাই না। ৪ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে মিয়ানমারের রাখাইন, তানপট্টি ও হাকা রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর লড়াই চলছে। একদিকে যেমন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে, অন্যদিকে গত মে মাস থেকে কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করছে সেদেশের সামরিক বাহিনী। নাইক্ষৎছড়ির তমব্রু সীমান্ত রেখায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা গত কয়েক বছর ধরে বসবাস করছে। সহিংসতার কারণে তাদের বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ, চিন, রাখাইন প্রদেশ ও স্যাগাইং অঞ্চলে গত ১৫ মাসে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে তুমুল সংঘর্ষে দেশটির সামরিক বাহিনীর অন্তত এক হাজার ৬০০ সৈন্য নিহত হয়েছেন। থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের দৈনিক ইরাবতির খবর অনুযায়ী, মংডুতে আরাকান আর্মির (এএ) হামলায় সীমান্ত রক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯ জন নিহত হয়। তারা ওই স্টেশনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে বিমান হামলা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের একাধিক স্থানে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এর আগে থেকেই গত এক মাস ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছিল।