মাস্ক রফতানিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:২৬ এএম, ২৯ মার্চ,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৩৩ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
দেশের প্রধান প্রধান পণ্যের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমলেও করোনাভাইরাসের সুরক্ষাসামগ্রী রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ, যা দেশের রফতানি বাণিজ্যের বহুমুখিতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। গত বছরের শুরুর দিকে এক থেকে দেড় কোটি ডলার পর্যন্ত মাস্ক রফতানি আয় ছিল। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে পণ্যটির রফতানি প্রবৃদ্ধিতে উল্লম্ফন হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর মধ্যে সার্জিক্যাল মাস্ক, ফেস মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, স্যু কাভার ও মেডিকেল গাউন ইত্যাদির প্রবৃদ্ধি হয়েছে বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎপাদন হ্রাস ও পণ্যের চাহিদা কমেছে। তবে বিপরীতে বেড়েছে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বা ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা। মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় পিপিই গাউন ও মাস্কে নতুন সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। ফলে মাস্ক রফতানিতে বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫০ কোটি ১০ লাখ ডলারের মাস্ক রফতানি করেছে।
এদিকে বিজিএমইএ’র তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রফতানি হয়েছে ৪০ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের মাস্ক। গত (২০১৯-২০) অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রফতানি হয়েছিল ৩৬ কোটি ৬২ লাখ ডলারের মাস্ক। এর বাইরেও বিভিন্ন কারখানা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী রফতানি করছে বলে জানা গেছে। গত কয়েক বছরে মাস্ক রফতানির প্রবৃদ্ধি খুব একটা ভালো ছিল না। কোটি ডলারের নিচেই ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা শুরুর পর থেকেই মাস্ক রফতানি বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের মাস্ক রফতানি করেছে বিজিএমইএ সদস্য কারখানাগুলো। ২০১৯ সালের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ২৭ লাখ ডলারের মাস্ক। তাতে ২০২০ সালে মার্চ থেকে জুলাইয়ে মাস্কের রফতানি বেড়ে ছিল ৮৮৩ শতাংশ। বিজিএমইএ’র তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের জুনে ১ কোটি ৯ লাখ মাস্ক রফতানি হয়েছিল। পরের মাস জুলাইয়ে সেটি বেড়ে ১ কোটি ২৪ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের জুলাইয়ে মাস্কের রফতানি বৃদ্ধি হয় ১ হাজার ১১৭ শতাংশ।
এদিকে বাণিজ্য-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে বিশ্বের শীর্ষ সংস্থা ট্রেড ডাটা মনিটরের (টিডিএম) প্রতিবেদন মতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার মূল্যের মাস্ক রফতানি করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৪ কোটি ডলার মূল্যের সার্জিক্যাল ও কেএন-৯৫ মাস্ক রফতানি করেছে। আলোচ্য সময়ে মাস্কের বিশ্ববাজার ছিল প্রায় ৬,৫০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ছিল চীনের দখলে।
উদ্যোক্তারা জানান, মহামারির কারণে সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। ভালো সম্ভাবনা থাকায় অনেকেই বিনিয়োগ করেছেন। নতুন বিনিয়োগও আসছে। অনেকেই সফলতা পেয়েছেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে সুরক্ষাসামগ্রী রফতানির আকার বাড়তে পারে। টিডিএম’র হিসাবে, বাংলাদেশের মোট মাস্ক চালানের ৪১ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই হয়েছে। আর জার্মানি হচ্ছে বাংলাদেশের এই পণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ আমদানিকারক। গত বছরের প্রথম এগারো মাসে বাংলাদেশের মাস্কের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক রাষ্ট্র হিসেবে উত্তর আমেরিকান দেশ কানাডা নিয়েছে ৭৭ লাখ ডলার মূল্যের মাস্ক। তবে কোনো কোনো দেশ পিস হিসেবে ও কিছু দেশ কেজি দরে মাস্ক ক্রয় করে থাকে। তবে টিডিএম বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত মাস্কের পরিমাণ-সংক্রান্ত কোনো উপাত্ত দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র পিস হিসেবে মাস্ক আমদানি করে থাকে। আবার কানাডা আমদানি করে কেজি দরে। বাংলাদেশ থেকে অন্য যেসব দেশ মাস্ক আমদানি করেছে সেগুলো হলো- ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য।
টিডিএম বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের ফলে চীনও বাংলাদেশ থেকে মাস্ক আমদানি করেছে। চীন সম্ভবত আংশিক-প্রস্তুত মাস্ক আমদানি করে সেগুলোকে উন্নততর করে বাইরে রফতানি করে। জনেভাভিত্তিক টিডিএম জানায়, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রফতানিকারক বাংলাদেশের এই খাতটি বিশেষ করে গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে লকডাউনের সময় বড় হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু করোনা সুরক্ষাসামগ্রী রফতানি আদেশ শুধু যে মহামারিকালে দেশের রফতানি বাজারের বৈচিত্র্যকরণে সাহায্য করেছে তা নয়, রফতানির সামগ্রিক বৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছে।
এদিকে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন ও রফতানিতে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছে বেক্সিমকো গ্রুপ। ২০২০ সালের মে মাসে ৬৫ লাখ পিস পিপিই গাউনের প্রথম চালান এমিরেটসের একটি উড়োজাহাজে পাঠায় তারা। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ইমার্জেন্সি এজেন্সির (এফইএমএ) জন্য দেশটির পোশাকের ব্র্যান্ড হেইনস এই পিপিই গাউন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। রফতানির পাশাপাশি দেশের বাজারেও সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করছে তারা।
বেক্সিমকো সূত্র জানায়, পিপিই ডিভিশন সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনের জন্য ২৫ একর জমির ওপর বিশ্বমানের পিপিই পার্ক স্থাপন করছে বেক্সিমকো। গত ফেব্রুয়ারি মাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার কবিরপুরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পিপিই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের উদ্বোধন করা হয়। এখানে মাসে দেড় কোটি পিস পিপিই উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। এখানে কাঁচামাল থেকে বিভিন্ন ওজনের লেমিনেটেড ফেব্রিক্স ও মেল্টব্লোন পদার্থ তৈরি হয়। তারপর এসব থেকে প্রস্তুত করা হয় জীবাণুমুক্ত ডিজপোজেবল আইসোলেশন ও সার্জিক্যাল গাউন, পুনঃব্যবহারযোগ্য আইসোলেশন গাউন, এন-৯৫ ক্যাপ টাইপ ও ফল্ডেবল টাইপ মাস্ক, সার্জিক্যাল মাস্ক, ডিসপোজেবল স্ক্র্যাপ, উভেন ও কিটেন স্যু কাভার ও হেড কাভার এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য পানিরোধী স্ক্র্যাপস। এ ছাড়া বেক্সিমকো ও ইন্টারটেক যৌথ উদ্যোগে পার্কের অভ্যন্তরে ১২ হাজার বর্গফিট জায়গাজুড়ে একটি সর্বাধুনিক ‘পিপিই সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ ল্যাব স্থাপন করেছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি রয়েছে। এই পিপিই ল্যাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের মানদন্ড অনুসারে পিপিই তৈরির জন্য সকল ধরনের পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। পার্ক উদ্বোধনকালে বেক্সিমকোর টেক্সটাইল ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নাভিদ হোসেন বলেছিলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সুরক্ষাসামগ্রীতে সারা বিশ্বে ‘বেক্সিমকো হেলথ’ ব্র্যান্ডকে প্রথম সারিতে নিয়ে যাওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এই উৎপাদন কেন্দ্রটি একাধারে উৎপাদক, ক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও সরকারকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে। কারণ এখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানদন্ড অনুসারে একইসঙ্গে সকল প্রকার পণ্য উৎপাদন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে বিশ্বের বৃহত্তম পিপিই উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এটি সেই লক্ষ্যকে দৃশ্যমান করছে। ওদিকে আগামী দিনে মাস্ক রফতানি আরো বাড়বে। কারণ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে নতুন বিনিয়োগ করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। তাদের করোনা সুরক্ষাসামগ্রী তৈরির মধ্যে রয়েছে সার্জিক্যাল মাস্ক, ফেস মাস্ক কেএন-৯৫ ও এন-৯৫, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, স্যু কাভার, মেডিকেল গাউন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি। এতে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।