নিয়ম ভেঙে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তাদের এনে বিমানে পদায়ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:৫৫ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ১১:৫৭ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৪
সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য মিলেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে নিয়োজিত বিমানের অর্থ বিভাগের পরিচালক বা প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মো. নওশাদ হোসেন প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। এই উপসচিবের এয়ারলাইনস অথবা পেশাদারি হিসাববিজ্ঞানের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। অন্যদিকে বিমানের অর্গানোগ্রামে সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত কোনো পদ নেই এবং প্রেষণে পদায়ন সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। নিয়ম ভেঙে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তাদের এনে বিমানে করা হয় পদায়ন, দেওয়া হয় পদোন্নতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে বিমানে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের তথ্য অনুযায়ী, একটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের বিভিন্ন বিভাগে উচ্চ পদগুলোতে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে বেশকিছু বিষয় দেখা হয়। এর মধ্যে নিয়োজিত ব্যক্তির এয়ারলাইনস এবং সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং কর্মদক্ষতা (কমপক্ষে ১৫-২৫ বছর) অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ বিমানের তথ্য বলছে, বিমান একটি নিবন্ধিত কোম্পানি সেহেতু বিমানের অর্গানোগ্রামে সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত কোনো পদ নেই। সেই সঙ্গে প্রেষণে পদায়ন সম্পূর্ণরূপে অবৈধ এবং মামলার মাধ্যমে এরই মধ্যে তা প্রমাণিত। অন্যদিকে, বিমানের এমডি, পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে বিমানের অভ্যন্তরীণ স্থায়ী পদ থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে অভিজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অথচ বিমানের স্থায়ী পদ থেকে নিয়োগ না দিয়ে গত ১৫ বছরে সচিবালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব, সহকারী সচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রেষণে বিমানের এমডি এবং পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এয়ারলাইনসেই সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে এভাবে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম আছে বলে তথ্য মেলেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমানের অর্থ বিভাগের পরিচালক পদটি একটি বিশেষায়িত পদ, ওই পদে নিয়োগ পেতে হলে বাণিজ্য বিভাগ হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ প্রফেশনাল ডিগ্রি এবং অর্থ ও হিসাব সংক্রান্ত ১৫ থেকে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বর্তমানে নিয়োজিত বিমানের অর্থ বিভাগের পরিচালক প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং এয়ারলাইনস অথবা পেশাদারি হিসাব বিজ্ঞানের কোনো অভিজ্ঞতাই তার নেই। তারপরও শুধু শেখ হাসিনা সরকারের মদদপুষ্ট হওয়ায় তাকে মন্ত্রণালয় থেকে বিমানে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, নওশাদ হোসেন অন্য বিভাগ থেকে তার প্রিয়ভাজন ব্যক্তিদের অবৈধভাবে অর্থ বিভাগে বদলির জন্য বারবার চেষ্টা করেছেন। পে-গ্রুপ ৩(২) তে জনবল না থাকা সত্ত্বেও তিনি বরাবর অতিউৎসাহী হয়ে সরাসরি অফিসার নিয়োগ করেন এবং নিয়োগ বাণিজ্য করেন। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মচারীদের ওপর দমন ও প্রেষণ প্রক্রিয়া চালু করেন। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে বিমান নারিতা স্টেশনে গ্রুপ ৭ এর পদে গ্রুপ-৮ এর কর্মকর্তা প্রেরণ করেন যা বৈদেশিক পোস্টিংয়ের সেটআপে নেই এবং বাংলাদেশ বিমানে কান্ট্রি ম্যানেজার (গ্রুপ-৭) এর চেয়ে ফিন্যান্স ম্যানেজারের উচ্চতর পদ (গ্রুপ-৮) অন্য কোথাও নেই। যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও নজিরবিহীন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরেন পোস্টিংয়ের ফলাফল প্রকাশ না করে পছন্দের কর্মকর্তাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য ৬ মাস পর বিমান লন্ডন স্টেশনের ফলাফল প্রকাশ করেন এবং অবৈধভাবে নতুন পদ সৃষ্টি করে তাকে পদায়ন করেন। এছাড়া আনাড়ি ও অনভিজ্ঞ কর্মচারীদের কাছে থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে ওই তথ্য যাচাই-বাছাই না করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হেনস্তা করার জন্য শোকজ, চার্জশিট দিয়ে দমন নিপীড়ন চালান।
সূত্র বলছে, বিমানের বিভিন্ন স্টেশনে পোস্টিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট পে-গ্রুপ না রেখে দ্বৈত গ্রুপ রাখার নিয়ম চালু রেখেছেন নওশাদ। যাতে তার পছন্দের ব্যক্তিকে পোস্টিং দিতে পারেন। পে-গ্রুপ ৬ এ অভ্যন্তরীণ কর্মীদের প্রমোশন বন্ধ রেখে নিয়োগ বাণিজ্য করার জন্য সরাসরি পে-গ্রুপ ৬-এ নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন, এতে অভ্যন্তরীণ কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি হয়। সরকারি ব্যাংকে (ঝুঁকি এড়ানোর জন্য) প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা রাখার নিয়ম থাকলেও বেসরকারি ব্যাংকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ নিয়মবহির্ভূতভাবে এবং অনুমোদন ব্যতীরেকে স্বল্পহারে সুদে স্থায়ী আমানত রেখেছেন। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ওইসব ব্যাংকে নিজের আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়া।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাউথ-বাংলা ব্যাংকে ১০ কোটি, এনআরবিসি ব্যাংকে ১৬১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ২০০ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকে ৮১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১০ কোটি এবং ফার্মারস ব্যাংকে ১০ কোটি স্থায়ী আমানত হিসাবে টাকা রেখেছে বিমান। যেখানে সরকারি ব্যাংকের সুদের হার ৯.৫ শতাংশ, সেখানে না রেখে পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ সুদ হারে আমানত রেখেছেন। এতে বিমান ২ শতাংশ হারে বিপুল পরিমাণ মুনাফা হারাচ্ছে। জানা গেছে, এই টাকা রাখার পেছনে রাজস্ব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও এফএমআইএস আবু সাইদ মো. মঞ্জুর ইমামের হাত রয়েছে। উভয়ের যোগসাজশে টাকা রাখেন তারা।
অনুসন্ধানে আরোও পাওয়া গেছে, দেউলিয়া ফার্মারস ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা আমানত গচ্চা দিয়েছে বিমান। এছাড়া আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের মাধ্যমে আমেরিকাতে ৫ লাখ ডলার পাঠাতে গিয়ে, নওশাদ হোসেন এবং মঞ্জুর ইমামের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ওই টাকা ভুল হিসাবে চলে গেছে। যা এখনো আদায় করা সম্ভব হয়নি। নওশাদের অপকর্ম কৌশলে গোপন করার জন্য এবং প্রমাণ গায়েব করার জন্য নওশাদকে গত ১১ জুলাই বদলির আদেশ দেওয়া হয় জনপ্রশাসন থেকে। বদলি আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও তার বদলি ঠেকিয়ে রেখেছেন তিনি। অন্যদিকে মঞ্জুর ইমামকে পরিচালক পদে পদায়ন করার চেষ্টায় বিভিন্ন মাধ্যমে তদবির করছেন। অথচ মঞ্জুর ইমাম বিমানের নিয়োগবিধি অনুযায়ী অযোগ্য। জানা গেছে, মঞ্জুর ইমাম স্নাতক পর্যায়ে ৩য় শ্রেণি প্রাপ্ত, যা বিমানের নিয়োগ বিধিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবু সাইদ মো. মঞ্জুর ইমাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ফার্মারস ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা আমানত থেকে এখন ইন্টারেস্ট পাচ্ছি আমরা। আমি মিটিংয়ে আছি, পরে কথা বলব।
এই বলে ফোন কেটে দেন তিনি। অন্যদিকে মো. নওশাদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিযোগিতার যুগে বিমান বাংলাদেশের টিকে থাকতে হলে এবং কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন করতে হলে, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য, এই প্রতিযোগিতার বাজারে বিমানের নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী উচ্চপর্যায়ের অর্থাৎ এমডি অ্যান্ড সিইও এবং পরিচালক পদে আসিনদের এয়ারলাইনসের কার্যক্রম ও ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ধারণা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ঘাটতি রয়েছে। অন্যতম কারণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনী থেকে বিগত সরকার কর্তৃক বিমানে প্রেরিত ও প্রেষণে নিয়োজিত সহকারী সচিব ও উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগদান।