কাগজের মানে ছাড়, তবুও পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে অনিশ্চয়তা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:৫৯ পিএম, ১৯ নভেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০২:৩১ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কাগজ সংকটের কারণে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে রিসাইকেল ফাইবার দিয়ে তৈরি কাগজে। মানে ছাড় দিয়েও আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই যথাযথভাবে তুলে দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
মুদ্রণ শিল্পের মালিকরা বলছেন, একদিকে কাগজ সংকট, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে অর্থ আটকে থাকায় এখনও অনেকেই বই ছাপানোর কাজ শুরুই করেননি। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, কাগজের সংকট থাকলেও পাঠ্যবই ছাপা সংকট থাকবে না। যথাসময়ে শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে কাগজের চাহিদা বছরে ১০ লাখ টন। আর ২০২৩ সালের পাঠ্যবই ছাপতে ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রয়োজন ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টন কাগজ। এই কাগজ সরবরাহ ঠিক রেখে আগামী বছরের প্রথম দিন পাঠ্যবই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং কাগজ কল মালিকরা বলছেন প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজের জন্য ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা থাকতে হয়। ভার্জিন পাল্প ছাড়া রিসাইকেল ফাইবার দিয়ে তৈরি কাগজে তা সম্ভব নয়। রিসাইকেল ফাইবারে তৈরি কাগজ উজ্জ্বল করলেও ৮৫ শতাংশতো নয়ই, ৮২ শতাংশের ওপরে উজ্জ্বলতা আনা সম্ভব নয়। এমনকি কয়েকটি ছাপাখানায় মাত্র ৭০ শতাংশের কম জিএসএম কাগজে বই ছাপার প্রমাণও পেয়েছে এনসিটিবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বই পেতে হলে ‘এমনটা মেনে নেয়া’ ছাড়া উপায় নেই।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এবার কাগজের সংকট আছে। কিন্তু মুদ্রণ মালিকরা ছাড় পেতে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তো ভার্জিন পাল্প ছাড়াই কাগজ তৈরি (রিসাইকেল ফাইবার দিয়ে) করতে বলেছি মিল মালিকদের। এর বেশি কোনও ছাড় পাবে না মুদ্রণ শিল্পের মালিকরা। বই ছাপার ক্ষেত্রে কোনও সংকট থাকছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বই ছাপান, তারা মাধ্যমিকে বই আগে ছাপতে শুরু করেছেন। মাধ্যমিকের বই ছাপা শেষে হলে তারা প্রাথমিকে বই ছাপবেন। আর যারা শুধু প্রাথমিকের বই ছাপান তারা বই ছাপা শুরু করে দিয়েছেন। প্রাথমিকে বই ছাপা নিয়ে সংকট ছিল, তা আর এখন নেই। কাগজ সংকট থাকলেও যথাসময়ে বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলেও দাবি করেন তিনি।
যে কারণে পাঠ্যবই ছাপানোর কাগজ সংকট : ডলার সংকট, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ না থাকা এবং ভার্জিন পাল্পসহ কাগজ তৈরির কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ার কারণে কাগজ কল মালিকরা চাহিদা অনুযায়ী যোগান দিতে পারছেন না। অন্যদিকে ‘নোট-গাইড’ বা অনুশীলন বই ছাপা, নতুন বছরের জন্য লেখা ও ছাপার কাগজ ব্যবহার হওয়ার কারণে পাঠ্যবই ছাপা সংকটে পড়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেরিতে দরপত্র আহ্বান করা সংকট তৈরির অন্যতম কারণ।
কাগজের মানে ছাড় : ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপতে এ বছর দরপত্র আহ্বানে দেরি করে এনসিটিবি গত জুনে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্তে উন্নতমানের অর্থাৎ ‘ভার্জিন পাল্পযুক্ত’ কাগজেই বই ছাপার কথা বলা রয়েছে। কিন্তু ভার্জিন পাল্প আমদানি না হওয়ায় চাহিদা মতো উন্নত কাগজ উৎপাদন করতে পারছেন না কাগজ কল মালিকরা। আর রিসাইকেল ফাইবার দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে যে কাগজ তা দিয়ে মুদ্রণ মালিকরা পাঠ্যবই ছাপছেন। দরপত্রে ন্যূনতম ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেসের (উজ্জ্বলতা) মুদ্রণ কাগজে পাঠ্যবই ছাপার কথা। কিন্তু কাগজ সংকটে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়টি এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। কারণ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি বই সরকার চেয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে ভার্জিন পাল্প সংকট। তাই রিসাইকেল ফাইবারে তৈরি কাগজের উজ্জ্বলতা ৮৩ শতাংশ থাকবে। তবে মুদ্রণ মালিকরা বলছেন ৮২ শতাংশের বেশি কোনওভাবেই সম্ভব নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুদ্রণ শিল্পের একাধিক মালিক বলেন, ভার্জিন পাল্প আমদানির জন্য এলসি দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ডলার সংকট মোকাবিলায় এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শতভাগ ক্যাশ মার্জিন দিলেও ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না। তাহলে কাগজ কীভাবে তৈরি হবে? সে কারণে রিসাইকেল ফাইবার দিয়ে তৈরি নিম্নমানের কাগজে বই ছেপে সংকট মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নানাবিধ সংকটের কথা তুলে ধরে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, আমরা যথাসময়ে বই সরবরাহের সর্বশক্তি নিয়োগ করি। কারণ হচ্ছে আমরা ব্যাংক থেকে লোন নেই, সেটা যথাসময়ে ফেরত না দিলে সুদ দিতে হয়। তাছাড়া যথাসময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে যারা মৌসুমি ওয়ার্কার, যারা বাইন্ডিং করেন, তারাও বসে থাকে না, যেখানে নগদ কাজ পায় সেখানে চলে যায়। মৌসুমে তারা বেশি টাকা রোজগার করে, মৌসুম শেষ হয়ে এলে তারা অন্য কাজে চলে যায়।
অন্যদিকে এবার কাগজের সংকট প্রকট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভালো কাগজ তৈরি করতে হলে বড় মার্জিনের এলসি লাগে, সেটা করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। যে কারণে পাল্পের সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা নেই। এখন নিম্নমানের কাগজেরও দাম বেড়ে গেছে। বই দেয়ার আগ্রহ আমাদের রয়েছে, তবে যথাসময়ে দিতে পারবো না। এর একটা কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ সংকট, পাল্প সংকট। তাছাড়া এই বছর ওয়ার্ক অর্ডারও দেরিতে হয়েছে। ফলে এই বছর ভালো কাগজে বই দেয়া সম্ভব নয়। আমরা নিম্নমানের কাগজে বই দিতে চাই না। নিম্নমানের বই দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা কাজ পাই না। কিন্তু এ বছর ভালো কাগজে বই দেয়া সম্ভব নয়। মুদ্রণ মালিকদের সবমিলিয়ে গত বছরের ২০ শতাংশের মতো জমা টাকা আটকা রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মুদ্রণ কলের এই মালিক বলেন, তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এনসিটিবি জানায়, মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই দেয়ার কথা রয়েছে। প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু করতে পারেনি অনেক মুদ্রণ মালিক। অনেকের সক্ষমতা থাকলেও গত বছরের পারফর্ম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) পাঁচ শতাংশ টাকা ফেরত না পাওয়ায় ছাপার কাজ শুরু করেননি। তাদের অভিযোগ, এই অর্থ ছাড় না হওয়া এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) ‘ক্লিয়ারেন্স লেটার’ না পাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না মুদ্রাকররা। এজন্য কার্যাদেশ পেয়েও বই ছাপাচ্ছেন না তারা।
মুদ্রণ মালিকরা অভিযোগ করেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা (প্রশাসনিক, বই বিতরণ) মাহফুজা খাতুন পিজির টাকা আটকে দিয়েছেন। তাকে ‘২ শতাংশ হারে উৎকোচ না দেয়ায়’ পিজি ছাড় করছেন না। সে কারণে বই ছাপার ক্ষেত্রে অনীহা দেখাচ্ছেন কল মালিকরা। পিজির অর্থ ছাড়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মুদ্রণ মালিকরা দীর্ঘদিন ধরেই এনসিটিবিতে তদবির করছেন। পিজি ফেরত না পাওয়ায় মুদ্রাকররা কাজ পেয়েও ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপা শুরু করছেন না, এতে চাপে রয়েছে এনসিটিবি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুদ্রণ মালিক বলেন, মাহফুজা খাতুন অনেক শক্তিশালী। ইতিমধ্যে তাকে শীর্ষ পর্যায় থেকে বদলি করার কথা বলা হলেও তা করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, পিজি ছাড়ের জটিলতা কাটাতে আমরা চেষ্টা করছি। এই সংকট সমাধানে ডিপিইর সঙ্গে কাজ চলছে। আশা করছি খুব শিগগিরই সংকটের অবসান ঘটবে। মাহফুজার বিষয়টি শুনেছি। অফিসের বিষয়টি অফিশিয়ালি শেষ হওয়া প্রয়োজন, ব্যক্তিগতভাবে নেয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, অনেকের কাছে শুনতে পাচ্ছি, ওনাকে ম্যানেজ করলে কাগজ পাস হয়। পরিদর্শন টিমকে যেভাবে বলেন, সেভাবে পরিদর্শন টিম নিয়ন্ত্রণ হয়। কাউকে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে, আবার কাউকে কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। সে কারণে বাজারে রিউমার আছে ওনার বিষয়ে। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গত দুই দিন ধরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে এসএমএস পাঠালেও কোনও সাড়া দেননি গবেষণা কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুন।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর ১ জানুয়ারি সরকার শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়। এবারও উৎসব করে পাঠ্যবইয়ে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা রয়েছে।