ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও বাড়ানো জরুরি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:৩৪ এএম, ৩০ জানুয়ারী,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫৭ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও অন্তত ছয় মাস বাড়ানো জরুরি বলে মত দিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী মহল। ব্যাংক কর্মকর্তারাও মনে করছেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও বাড়ানো উচিত। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, যেহেতু এক বছর সময় দেয়া হয়েছিল, সেহেতু এখন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে সময় আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। প্রসঙ্গত, করোনা সংকটের কারণে ২০২০ সালজুড়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়নি ব্যবসায়ীদের। সরকারের নির্দেশনা এবং ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২০ সালে কোনও কিস্তি পরিশোধ না করেই খেলাপি হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন ঋণগ্রহীতারা। সদ্য বিদায়ী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা শেষ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সময়সীমা নতুন করে আরও ছয় মাস থেকে এক বছর বাড়ানো জরুরি। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, আমরা বলেছি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো উচিত। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও ঠিক হয়নি। এখনও করোনা মহামারি চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার দ্বিতীয় ধাপ চলছে। এর ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি সময় বাড়ানো না হয় তাহলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর ব্যবসায়ীরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন সেক্ষেত্রে ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে আমাদের দাবি, অন্তত আরও ছয় মাস ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়াতে হবে। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও অন্তত এক বছর বাড়ানো উচিত। তার মতে, দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখনও স্থবির। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা যদি না বাড়ানো হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হয়ে পড়বেন। আর ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হলে ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো হবে না। এ কারণে আরও অন্তত এক বছর সময়সীমা বাড়ানো জরুরি।
এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, জাতীয় সংসদেও আমি বলেছি ব্যবসায়ীদের আরও ছয় মাস সময় দেয়া উচিত। তিনি বলেন, যদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো না হয়, তাহলে ব্যবসায়ী ও ব্যাংক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এখনও করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলছে। এখনও অর্ডার বাতিল হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকের পক্ষেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তবে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত মনে করেন, ব্যাংকগুলোকে স্বাভাবিক নিয়মে আসতে হবে। ঋণের কিস্তি স্বাভাবিক নিয়মে আদায় করা শুরু করতে হবে। সময় বাড়িয়ে খুব বেশি উপকার হবে না, কারণ অনেকেই সুযোগের অপব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের আলাদাভাবে সুযোগ দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, এখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ার পথে। মূল্যস্ফীতিও কমে গেছে। করোনায় মৃত্যুর হারও কমেছে। ভ্যাকসিন প্রদানও শুরু হয়ে গেছে। আশা করছি, আগামী চার পাঁচ মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। এ কারণে একদিকে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেও বাঁচাতে হবে। আর এটি করতে হলে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও মনে করছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা হবে। যদিও গত বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে সময়সীমা না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন দেশের সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। একই অভিমত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও। সে হিসেবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ঋণ শ্রেণিকরণের মেয়াদ গণনা শুরু হওয়ার কথা। ২৭ জানুয়ারির বৈঠকে গভর্নর ফজলে কবির ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংক এমডিদের মতামত জানতে চান। তখন ব্যাংক এমডিরা বলেন, উদ্যোক্তাদের কথা চিন্তা করে বছরব্যাপীই ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়া হয়েছে। নতুন করে মেয়াদ না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন অধিকাংশ এমডি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের যে সুযোগ দেয়া হয়েছিল, অনেকেই সেই সুযোগের অপব্যবহার করেছেন। আবার অনেকে সত্যিকার অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কে কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কোন কোন ঋণ আদায় জরুরি আর কাদেরকে আরও সুবিধা দেয়া উচিত তার পর্যালোচনা হওয়া জরুরি।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে বিদায়ী বছরের এপ্রিলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। সরকারের নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে জানায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনও ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণিমানে কোনও পরিবর্তন আনা যাবে না। এরপর এ ছাড়ের মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরে তৃতীয় দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে এ সুযোগ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
যদিও ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়ে গভর্নরকে চিঠি দেয়া হয়।
গত ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় ঋণ শ্রেণিকরণের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়েছিল। তখন পর্ষদ থেকে এ বিষয়ে নেতিবাচক মতামত দেয়া হয়। গত বুধবার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাও একই মতামত দিয়েছেন বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে গত বছরজুড়ে ঋণ পরিশোধে শিথিলতা দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে তখন আমরা সবাই স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু এ ধরনের সুবিধা দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। এজন্য এবিবির পক্ষ থেকে আমরা ঋণ শ্রেণিকরণের মেয়াদ না বাড়ানোর অনুরোধ করেছি।
ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকার্স সভা’ আয়োজন করা হয়। মহামারির কারণে বুধবারের বৈঠকটি হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে।