বিশেষায়িত হিমাগারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে চাষিদের সবজি-ফল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫০ পিএম, ১৬ অক্টোবর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:২৫ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
নাটোরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায় পাবনায় উৎপাদিত সবজি ও ফল। এ ক্ষেত্রে আগাম জাতের সবজি-ফলে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হলেও মৌসুমে এসে তারা ন্যায্যমূল্য পান না। আবার সবজি ও ফল পচনশীল হওয়ায় তারা কম দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমন অবস্থায় জেলার ঈশ্বরদীতে বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনের জন্য চাষিরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন।
কৃষকরা বলছেন, বিশেষায়িত হিমাগার হলে মৌসুমেও তারা যেমন ন্যায্যমূল্য পাবেন তেমনি বছরজুড়েই ফল-সবজির সুষম যোগান অব্যাহত থাকবে। এতে করে ভোক্তাদের আকাশচুম্বী দামে কোনো ফল বা সবজি কিনতে হবে না। পাবনার ঈশ্বরদীতে বহু নামকরা সবজি চাষি আছেন যাদের নামের সঙ্গে তাদের উৎপাদিত সবজি বা ফলটির নাম সংযুক্ত করে দিয়েছেন স্থানীয়রা। যেমন- এখানে রয়েছেন শাহজাহান আলী বাদশা ওরফে পেঁপে বাদশা, জাহিদুল ইসলাম ওরফে গাজর জাহিদ, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে কুল ময়েজ, আব্দুল বারী ওরফে কপি বারী, আমজাদ হোসেন ওরফে পেয়ারা আমজাদ, আব্দুস সাত্তার ওরফে শিম সাত্তার। সবজি চাষ করে তাদের মতো আরও বহু চাষি লাভবান হয়েছেন। তরুণ চাষিরা এগিয়ে আসছেন সবজি বা ফল চাষে। তবে কৃষকরা কিছু সমস্যায়ও রয়েছেন। তারা সম্প্রতি পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেনের সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। তারা জানান, বিশেষায়িত হিমাগার থাকলে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য নষ্ট হবে না।
তারা আরও জানান, এক সময়ে প্রচুর উৎপাদনের কারণে কৃষকরা ভালো দাম পান না। কিন্তু কিছুদিন পরই বাজারে যোগান কমলে দাম বেড়ে যায়। এতে কৃষক বা ভোক্তা কেউই লাভবান হন না। যদি বিশেষায়িত হিমাগার থাকতো তাহলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই লাভবান হতেন। চাষিরা জানান, ভরা মৌসুমে চায়না গাজর এসে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। এতে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েন। জাহিদুল ইসলাম ওরফে গাজর জাহিদ জানান, তিনি দীর্ঘ তিন দশক ধরে গাজর চাষ করছেন। তিনি দেশের চাষি পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি জমিতে গাজর চাষ করেন। গাজর চাষের সমস্যা সম্পর্কে জাহিদ জানান, হিমাগারের অভাবে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ এক সময়ে প্রচুর উৎপাদনের কারণে বাজারমূল্য পান না। কিন্তু কিছুদিন পরই বাজারে যোগান কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে যায়। বিশেষায়িত হিমাগার থাকলে তিনি গাজর সংরক্ষণ করতে পারতেন। এতে তিনি যেমন উপকৃত হনে তেমনি ভোক্তারাও নায্য দামে গাজর পেতেন। বাইরে থেকে আমদানি করা ২০০-৩০০ টাকা কেজি দরের গাজর কেনা লাগত না।
তিনি অভিযোগ করেন, দেশে উৎপাদন মৌসুমেও চীন থেকে গাজর আমদানি করায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়টি তিনি নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় রাখতে বলেন। সিদ্দিকুর রহমান ওরফে কুল ময়েজ জানান, ঈশ্বরদীতে বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের।
তিনি জানান, তার খামারের পেয়ারা এক সময়ে ভেড়া দিয়েও খাওয়াতে হয়েছে। অথচ ফল রাখার বিশেষায়িত হিমাগার থাকলে তিনি গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত চাষির তালিকায় থাকতেন না। আব্দুল বারী ওরফে কপি বারী জানান, তিনি কপি চাষে জাতীয় পদক পেয়েছেন। বিশেষায়িত হিমাগার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, কিছুদিন ৬০ টাকা কেজি দরে কপি বিক্রি করার পর পাঁচ টাকা কেজি দরে বেচতে চাই না। আমরা চাই, সবসময় যেন নায্যমূল্য পাই। আর ভোক্তারাও নায্যমূল্যে যেন কিনতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সবজি পচনশীল হওয়ায় তারা সংরক্ষণ করতে পারেন না। তবে বিশেষায়িত হিমাগার হলে সারাবছর ন্যায্যমূল্যে সবজি ও ফলমূল কেনাবেচা হতো।
পাবনার মুলাডুলি সবজি আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন অন্তত সেখানে পাঁচ কোটি টাকার সবজি কেনাবেচা হয়। সারাবছরই ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখরিত থাকে মুলাডুলি সবজি আড়ত। প্রতিদিন এই আড়ত থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সবজি পাঠানো হয়। মুলাডুলি শিমের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, আড়তের পুরো জায়গায় শতশত মণ সবজি সবজি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখানে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আশপাশের এলাকাতেও রাখা হয়েছে সবজি। মুলাডুলি সবজি আড়তের সাবেক কোষাধ্যক্ষ আমিনুর রহমান জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। অন্যান্য এলাকার আড়ত সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে বসলেও মুলাডুলির আড়ত বসে সপ্তাহে সাত দিনই। হাটের আড়তদারসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে প্রতিদিন প্রায় সাতশো পাইকার সবজি কিনতে আসেন। আর ৩০০-৩৫০ টন সবজি যায় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিন এই হাট থেকে শুধুমাত্র শিমই ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক কেনাবেচা হয়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় এই শিম। চর মিরকামারি গ্রামের চাষি আনারুল, শহিদুল, মানিকনগরের আব্দুল হাইসহ বহু চাষি জানালেন, তারা এখানে সহজেই সবজি বিক্রি করতে পারেন। আড়তে সবজি বিক্রি করতে আসা বেশকিছু চাষি অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও টকশোতে জনপ্রতিনিধিরা যখন বক্তব্য দেন তখন মনে হয় চাষির জন্য বিরাট কল্যাণকর কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে চাষির কল্যাণে তেমন কিছুই হয় না। চাষের উপকরণের দাম বাড়ায় চাষির উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও চাষি নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছেন। এখন কৃষিপণ্য কেনার সময় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালপত্র কেনেন। এক্ষেত্রে প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বেশ কয়েকজন সবজি চাষি জানান, অন্য ফসলের মতো সবজি ঘরে রাখা যায় না। তাই বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপিত হলে তারা নায্যমূল্য না পেলে সংরক্ষণ করতে পারবেন। এতে তারা সিন্ডিকেটের কবল থেকে বাঁচবেন।
বাংলাদেশ ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সভাপতি শাহজাহান আলী বাদশা জানান, শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। এ অঞ্চলের কৃষকের উৎপাদিত পণ্য হিমাগারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে। পেঁপে, বেগুন, গাজরের রাজধানী খ্যাত ছলিমপুরে সরকারিভাবে একটি এগ্রোবেজড ইপিজেড এবং হিমাগার স্থাপনের দাবি জানান তিনি। এতে এ অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য পচন বা নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, সবজিপ্রধান এলাকা ঈশ্বরদীতে এক বা একাধিক বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপিত হলে চাষিরা উপকৃত হবেন, চাষিরা এ দাবি জানিয়েছেন। তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানাবেন