মধুমতি ব্যাংক ভোলার-চরফ্যাশন শাখার কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:২৩ এএম, ২৭ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৪৭ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বহুল আলোচিত লক্ষীপুর-২ আসনের এমপি মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুল এবং পিকে হালদারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত, দুদক এবং প্রশাসন নানা পদক্ষেপ নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে ভোলা-৪ আসনের এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মধুমতি ব্যাংক চরফ্যাশন শাখা থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট ও পাচারের আরেক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা-২ এর কর্মকর্তাদের চলমান অনুসন্ধাকালে সোমবার (২৫ জানুয়ারি) চেয়ারম্যানের দফতরে নতুন আরো একটি তথ্য প্রমাণসহ শত শত কোটি টাকা পাচার ও লোপাটের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আর এই অভিযোগকারী হলেন মধুমতি ব্যাংক ভোলা জেলার চরফ্যাশন শাখার সাবেক ম্যানেজার এবং ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ রেজাউল কবির।
সোমবার (২৫ জানুয়ারি) দুদক চেয়ারম্যানের দফতরে দাখিলকৃত অভিযোগে (ভোলা-৪) এর এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, তার ভাই, ভাতিজা এবং পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বেআইনীভাবে মধুমতি ব্যাংক চরফ্যাশন শাখা থেকে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে ইতিমধ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ১। মেসার্স মনোয়ারা ট্রেডার্স ২। মেসার্স ইউনুস আল মামুন ৩। বকশী এন্টারপ্রাইজ ৪। মেসার্স মিলন ট্রেডার্স ৫। মেসার্স জসিম কনস্ট্রাকশন ৬। মেসার্স হাওলাদার ট্রেডার্স ৭। ফখরুল ইসলাম ৮। উপকূল কনস্ট্রাকশন। ৯। মা ট্রেডার্স ১০। গ্রামীণ এন্টারপ্রাইজ ১১। চার দেওয়াল ডেকোরেটর ১২। উপকূল ব্রিকস্ ১৩। রুহি ফার্নিচার ১৪। কাইফ এন্টারপ্রাইজ ১৫। মোঃ জাহিদুল ইসলাম।
এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি জ্যাকব, তার ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ, ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ ও তার পরিবারের সদস্যরা। এসব প্রতিষ্ঠানের একাউন্টের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য, লেনদেন, অপ্রদর্শিত আয় লেনদেন হয়ে থাকে।
দুদকের দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে, মধুমতি ব্যাংক চরফ্যাশন শাখার একাউন্টকৃত সব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে ইতিমধ্যে বৈধ ও অবৈধভাবে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
১৩ জানুয়ারি ঢাকা থেকে মধুমতি ব্যাংক লিমিটেড চরফ্যাশন শাখায় অডিট এন্ড ইন্সপেকশন টিমের তাৎক্ষণিক পে-অর্ডার স্টক নিরীক্ষায় ১২টি পে-অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার হিসেবে গড়মিল উদঘাটন করেছেন। ওই ১২ টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার গড়মিলের ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা এমপি জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ তার বিকাশ ব্যবসার জন্য নিয়ে টাকা আটকে রেখেছেন।
অভিযোগকারী মধুমতি ব্যাংকের এই শাখার সাবেক ম্যানেজার মোঃ রেজাউল কবির লিখিতভাবে এমপি জ্যাকব, তার ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ (ব্যবসায়ী), তার ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ উক্ত ব্যাংকের শাখায় কর্মরত এসিস্টেন্ট অফিসারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করলেন।
দীর্ঘদিন যাবৎ এমপি জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যরা ইচ্ছমাফিক মধুমতি ব্যাংকের এই শাখাটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওই শাখার ম্যানেজারকে জিম্মি করে ব্যাংকের ক্যাশ থেকে প্রতিদিনই ৫-১২ কোটি টাকা নিয়ে তাদের বিকাশে পেমেন্টের চাহিদা পূরণ করা হতো। কিন্তু অধিকাংশ সময় উক্ত টাকার বিপরীতে চেক দিতেন না। তবে মাঝে মধ্যে সকালে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যেতেন। এমধ্যে কিছু টাকা বিকেলে ফেরত দিতেন।
এসব অনৈতিক লেনদেনে ওই শাখা ম্যানেজার বারংবার অসম্মতি জানানোর পরেও প্রায় প্রতিবারই এমপি জ্যাকব নিজে এবং তার ভাতিজা ব্যাংকের এ্যাসিস্টেন্ট অফিসার তরিকুল ইসলাম শরীফের মুঠোফোনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে লেনদেনগুলো অব্যাহত রাখতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তা এমপির ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ পুনরায় আগের ন্যায় আরো ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা তুলে নেন। টাকাগুলো সকালে নিয়ে বিকেলে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবদি তা ফেরত দেননি। এমনকি উক্ত টাকার বিপরীতে কোন প্রকার চেক প্রদান করেননি। এসব বিষয়ে কথা বলায় মধুমতি ব্যাংকের এই শাখার ম্যনেজারকে নানা হুমকি দেয়া হয়েছে। মধুমতি ব্যাংকের এই শাখায় অনিয়মটাই ছিল নিয়ম এবং এমপি জ্যাকবের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত।
অভিযোগে আরো জানা গেছে, মনোয়ারা ট্রের্ডাসের মালিক জনাবা মনোয়ারা বেগম উক্ত প্রতিষ্ঠানে আয় বহির্ভূত অতিরিক্ত লেনদেন সহজভাবে করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের ছেলে ও এমপির ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ এই ব্যংকের অফিসার নিজেই তার মায়ের স্বাক্ষর করে থাকেন।
মিলন ট্রেডার্সের মালিক এমদাদুল হক মিলন-এমপি জ্যাকবের নির্বাচনী এলাকার দুইটি উপজেলা, একটি পৌরসভা ও ৪টি থানায় সরকারি বাজেট বরাদ্দকৃত কাজের বন্টন ও বন্টনকৃত কাজের কমিশনসমূহ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব কাজের কমিশনের সাদা ও কালো টাকা এমদাদুল হক মিলন ও এমপির ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকেন।
গত বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে দুদকের বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের চিহ্নিত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে ভোলা-৪ আসনের সাংসদ আব্দুল্লাহহ আল ইসলাম জ্যাকবকে চিহ্নিত করা হয়। এরপর হঠাৎ করেই আলোচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন অস্বাভাবিক ভাবে কমিয়ে দেন। আর বেশিরভাগ লেনদেনই ১ হাজার টাকার নোটের বান্ডেল করে ট্রাভেল ব্যাগের মাধ্যমে হ্যান্ড ক্যাশ করে শত শত কোটি টাকা ১টি নোয়া মাইক্রোবাস যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৩৫৩৬, ড্রাইভার সাইফুল ও তরিকুল ইসলাম শরীফ চরফ্যাশন হতে ভোলা এবং চরফ্যাশন বেতুয়া লঞ্চ ঘাট থেকে ঢাকা আনার পর পাচার হতো।
২০ জানুয়ারি মধুমতি ব্যাংকের এই শাখার সাবেক ম্যানেজার মোঃ রেজাউল কবির ভোলা প্রেসক্লাবে ও বিভিন্ন সাংবাদিকদের কাছে এমপি জ্যাকব ও পরিবারের সদস্যদের বিরূদ্ধে এক সংবাদ সম্মেলন দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিকদের ও সংবাদ সম্মেলনের এসব তথ্য স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগকারী মোঃ রেজাউল কবির ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। আর এই হুমকির বিষয়ে ২৩ জানুয়ারি ভোলা সদর থানায় তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম একটি সাধারণ ডায়েরী করেছেন, ডায়েরী নং-১০৮৫।