কেজিতে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে চালের দাম : ডিমের হালি হাফ সেঞ্চুরি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৭ পিএম, ১৩ আগস্ট,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৩১ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি প্রতি ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে চালের। এর মধ্যে মোট চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা, আর চিকন চালের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা পর্যন্ত। বন্যার প্রভাব ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির পর এবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবাসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ মিলাররাই চাল মজুদ করে সংকট সৃষ্টি করছেন। আর তাতেই দাম বাড়ছে। চালের আগেই দাম বেড়েছে সয়াবিন তেল, ডিম ও সবজির। এতে চরমভাবে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ।
বাড্ডা এলাকায় ৫ বছর ধরে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন কিশোরগঞ্জের নাইম মিয়া। তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। এতদিন ৫২ টাকা কেজি চাল কিনেছি। আজকে গিয়ে দেখি সেই চাল ৫৮ টাকা কেজি। আমাকে বাড়তি টাকা কে দেবে? সব কিছুর দাম বাড়তি, কিভাবে চলব?
আজ শনিবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর খুচরা বাজারে সবচেয়ে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে। আর মাঝারি মানের মোটা পাইজাম কিংবা স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা কেজিতে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগের দিনও এই চাল বিক্রি হয়েছে ৪৬-৪৮ টাকা ও ৫২ টাকা কেজিতে। বিআর ২৮ ও ২৯ জাতীয় চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজিতে। মিনিকেট ৭০ থেকে ৭৪ এবং নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও বিআর-২৮ জাতীয় চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছিল ৬৮ থেকে ৭২ এবং নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এসব চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ টাকা করে।
এ ছাড়া সব ধরনের পোলাও চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা। বাজারে চাল কিনতে আসা অজিজুল হক বলেন, দাম তো বাড়ছেই। যত দিন পারি ততদিন কিনব, কারণ খেয়ে থাকতে হবে তো। তিনি বলেন, আমরা তো চাইলেই কিছু করতে পারি না, আমাদের কিছু করার নেই।
কারওয়ান বাজারে নওশীন আজিজ নামে একজন ক্রেতা বলেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। কয়দিন যে আমরা চলতে পারব বলতে পারছি না। মহাখালীর ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী সুমন পাটোয়ারী বলেন, চালের দাম বস্তায় বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। মোটা পাইজম চাল আগে কেনা ছিল ২৪০০ টাকা বস্তা (৫০ কেজি ওজন)। সেই বস্তাগতকাল কেনা পড়েছে ২৬৫০ টাকা। যাতায়াত খরচসহ আমার কেনা পড়ছে ৫৫ টাকার বেশি। তাই বিক্রি করছি ৫৭-৫৮ টাকা। এইভাবেই সবধরনের চালের দাম বেড়েছে।
গুলশানের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, রশিদের মিনিকেটের বস্তা ছিল ৩৩৫০ টাকা। সেই বস্তাগতকাল আমাকে কিনতে হয়েছে ৩৫৫০ টাকায়। খরচসহ ৭৩ টাকা কেজি কেনাই পড়েছে। বিক্রি করতে হবে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা কেজিতে। অথচ এই চাল এক সপ্তাহ আগে ৬৫ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। এছাড়াও ৩৫০০ টাকার নাজিরশাইল চালের বস্তা ৩৮শ টাকায় কেনা পড়ছে। খরচসহ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের চাটখিল রাইস এজেন্সির কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বলেন, লোডশেডিং ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে চাল উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি যাতায়ত ভাড়া বেড়েছে। এ কারণে এখন চালের দাম বাড়ছে। মিলাররা চালের দাম বাড়িয়েছে। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। রাজধানীর মালিবাগ বাজারের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মোল্লা বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে চালের দাম প্রতিদিনই দুই-এক টাকা করে বাড়ছে।
আড়ৎদাররা বলেন, তেলের দাম বেড়েছে তাই দাম বাড়ছে। চালের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী নাজমুস শাকিব বলেন, বন্যার কারণে এ বছর চালের উৎপাদন কম হয়েছে। এরপর সরকার চাল আমাদানির উদ্যোগ নিলেও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে চাল আনা হয়নি। এখন নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ ও যাতায়ত খরচ বেড়েছে, ফলে বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। একই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী মন্ডল হোসেন বলেন, মিলাররা চাল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। তারা দাম বাড়িয়েছেন, আস্তে আস্তে চাল ছাড়বে। এ কারণে চালের দাম বাড়ছে।
সরকার কী করছে : দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল আমদানির অনুমতি, শুল্ক কমিয়েছে, বাজারে অভিযানসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তাতে খুব বেশি সুফল মেলেনি। সরকার ১০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানির অনুমতি দিলেও আমদানি হয়েছে খুবই কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য মতে, এ পর্যন্ত মাত্র ১৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে বেসরকারিভাবে।
সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, যারা অবৈধ মজুদ করে চালের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য মিলাররা ধান ৩০ দিন ও চাল ১৫ দিনের বেশি মজুদ করে রাখতে পারবে না। যারা অবৈধভাবে মজুদ করে রাখবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত উৎপাদন আছে, সরবরাহ আছে অথচ চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধানের যদি ঘাটতি থাকত, তাহলে আমদানি করে তা পুষিয়ে নেয়া হতো। কিন্তু আমদানির লাইসেন্স দেয়ার পরও তো আমদানি করেননি। ১৭ লাখ মেট্রিক টনের আমদানির অনুমতির জায়গায় মাত্র ৩ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করেছেন। তার মানে পর্যাপ্ত চাল আছে। তাহলে দাম বাড়ছে কেন? ব্যবসায় মুনাফা করতেই হয়। তার মানে এই নয় যে, গলা কেটে মুনাফা করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়াতে হবে এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া হবে না।
ডিমের হাফ সেঞ্চুরি : নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরত বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই পণ্যে দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণের প্রোটিনের উৎস ডিমও ধীরে ধীরে অনেক দামি পণ্যে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের হালি দামে হাফ সেঞ্চুরি পার করেছে। হালি প্রতি মুরগির ডিম (লাল) বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। আর ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও ডজন প্রতি ডিম ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তা এখন ডজনে ২০-২৫ টাকা বেড়েছে। একটি ডিমের দাম পড়ছে প্রায় ১৩ টাকা। পাইকারি বাজারে একই ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১ থেকে ১২ টাকায়। প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪৪ থেকে ১৪৫ টাকায়।
অন্যদিকে হাঁসের ডিম হালি বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। অর্থ্যাৎ প্রতি ডিমে ক্রেতাকে খরচ করতে হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকা। শনিবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ডিমের দামের এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও ডিমের উৎপাদন কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিক্রেতারা। জানতে চাইলে রামপুরা বাজারের ডিম বিক্রেতা বেলাল বলেন, ডিমের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ উৎপাদন কমে গেছে।
দাম বাড়ায় ডিম বিক্রি কমেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাম বাড়লে বিক্রি কিছুটা কমে। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হওয়ার কারণে তেমন কমে নাই্। দাম বৃদ্ধির কারণে এখন মানুষ একটু কম দামে পাওয়ার আশায় বাজারে এসে ডিম কিনছে। এলাকার দোকানে একটু বেশি দামে কিনতে হয়। এছাড়া অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দোকানে ডিম রাখছে না অতিরিক্ত দামের কারণে।
তথ্য মতে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৫০ ভাগ ডিম-মুরগির জোগান দেন গাজীপুর জেলার খামারিরা। এক সময় গাজীপুর জেলায় ডিম উৎপাদনকারী বা লেয়ার মুরগির খামার ছিল ৪ হাজার ১০৬টি ও ব্রয়লার মুরগির খামার ছিল ২ হাজার ৫৬৫টি। কিন্তু করোনাকাল ও ক্রমাগত লোকসানের কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মহামারি ও পরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সবচেয়ে বেশি খামার বন্ধ হয়ে গেছে।