বিদ্যুৎ সংকটে পাবনা বিসিকে কমেছে উৎপাদন, বেড়েছে খরচ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৩৮ পিএম, ১ আগস্ট,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৩৮ এএম, ১৩ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
চলমান বিদ্যুৎ সংকটে দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী অঞ্চল পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর উৎপাদন কমেছে। দিনের মধ্যে কয়েক দফা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে উৎপাদন খরচও। সংকট নিরসনে উৎপাদন সচল রাখতে শিল্প নগরীকে লোডশেডিংমুক্ত রাখার আবেদন জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে আবেদন জানিয়েছে পাবনা বিসিক কর্তৃপক্ষ। পাবনা বিসিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১১০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত বিসিক শিল্প নগরীর ১৭২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ১৬৯টি, প্রতিষ্ঠান যার বেশিরভাগই খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
পাবনা বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পাবনা বিসিক শিল্প নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন খাদ্যপণ্য উৎপাদন হয়, যা দেশের বিসিক শিল্প নগরীগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণ খাদ্যের উৎপাদন। পাবনা বিসিক শিল্প নগরী এলাকার চাল, আটা, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে বিরাট ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর এ শিল্প নগরী থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়, যার সিংহভাগই খাদ্যপণ্য। দেশব্যাপী চলমান বিদ্যুৎ সংকটে বর্তমানে বিদ্যুৎ-নির্ভর এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান বিসিক ডিজিএম।
সরেজমিনে বিসিক শিল্প নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, উৎপাদন চলমান অবস্থায় বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যাওয়ায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল। পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ আসলে মেশিন চালু করতে অতিরিক্ত সময় ও বিদ্যুৎ খরচের কারণে উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। পাবনা বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ আর স্পেশালাইজড রাইস মিলের জিএম মো. আক্তারুজ্জামান রাসেল বলেন, এ কারখানাটিতে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা অপারেশন করলে ৮০০ মেট্রিক টন ধান মাড়াই করে ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু সেজন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন।
স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করা সম্ভব হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদন ২৫০ থেকে ৩০০ মেট্রিক টনে নেমে এসেছে। বিশাল এ প্রতিষ্ঠানটি পুরোদমে চালু রাখতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন হলেও বর্তমানে অর্ধেক বিদ্যুৎও পাওয়া যাচ্ছে না, যোগ করেন তিনি। এ আর স্পেশালাইজড রাইচ মিলের ম্যানেজার (উৎপাদন) মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লোডশেডিংয়ের কারণে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে মিলের বিভিন্ন ইউনিটে কাঁচামাল আটকে যায়। পুনরায় বিদ্যুৎ আসলে মিল চালু করার আগে জমে থাকা অর্ধনষ্ট কাঁচামাল সরিয়ে পুনরায় মিলকে কর্মক্ষম করতে প্রায় ১ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হয়। এভাবে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে মিলের উৎপাদন প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ব্যাহত হয়। এতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম এ চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের চালের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমে গেছে। পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩ শতাংশ, বলেন তিনি। পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর আটার কারখানা তুষার ফ্লাওয়ার মিলের স্বত্বাধিকারী আখতার হোসেন বলেন, 'আমার কারখানায় স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা চালু রেখে ১৮০ টন আটা উৎপাদন করা হতো। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে এখন প্রতিদিন ১১ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি মিল চালানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ১০০ থেকে ১১০ মেট্রিক টনে নেমে এসেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি বারবার মেশিন চালু করতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। আর নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল। এতে করে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের বাজারজাতকরণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি', বলেন তিনি।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, বড় কারখানার পাশাপাশি ছোট কারখানাগুলোর অবস্থা আরও করুণ। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ছোট কারখানাগুলোর যাদের অটোমেটিক মেশিন নেই, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করে উৎপাদন করতে উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
বিসিকের ছোট ডাল কারখানার মালিক আমির হোসেন জানান, তিনি তার কারখানা প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা চালু রেখে ১০ মেট্রিক টন ডাল প্রক্রিয়াজাত করেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে একই শ্রমিক দিয়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ মেট্রিক টনের বেশি ডাল উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত শ্রমিক খরচের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্যশস্য উৎপাদন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।
পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর স্টেট অফিসার আব্দুল লতিফ বলেন, 'বিদ্যুতের চলমান সংকটের কারণে পাবনা বিসিক শিল্প নগরী এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। পাশাপাশি বার বার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা ব্যয় করায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় পাবনা বিসিকের উৎপাদন সচল রাখার স্বার্থে পাবনা বিসিককে লোডশেডিংয়ের আওতামুক্ত রাখার অনুরোধ জানিয়ে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিভাগকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ বিষয়ে পাবনার নেসকো-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুল হক বলেন, 'নেসকো-২ এর অধীনে প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১২ মেগাওয়াট চাহিদা শুধু শিল্প নগরী এলাকার জন্য। বিদ্যুতের উৎপাদন কম হওয়ায় জাতীয় গ্রিড থেকে যখন-যেভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছি, তেমনিভাবে গ্রাহকদের সরবরাহ করা হচ্ছে। শিল্প নগরীতে একটি লাইন চালু রেখে আরেকটি লাইন বন্ধ করা হচ্ছে, যাতে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সরবরাহ প্রাপ্তি অনুযায়ী গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ সবসময় সচেষ্ট রয়েছে, বলেন তিনি।