আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৮ এএম, ২০ জুন,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৫৬ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
দেশের সর্ববৃহৎ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড বা মেটলাইফ বাংলাদেশ প্রায় ছয় কোটি ৩২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ বছরের নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এমন ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এজেন্সি অফিস খরচ ও ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য ওই মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট পরিশোধ করেনি— ভ্যাট গোয়েন্দাদের তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অপরিশোধিত বা ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট বা মূসক আদায়ে দফায় দফায় চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত তা পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ভ্যাট নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা অধিদফতর ও মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্সের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৮ মে আলিকোর (আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যতটুকু জানি বকেয়া বা ফাঁকি দেয়া টাকা এখনও জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। প্রাথমিক দাবিতে ভ্যাটের বকেয়ার পরিমাণ আরও বেশি ছিল। এ বিষয়ে তারা লিখিত জবাব দেয়। আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বক্তব্য বিচার ও বিশ্লেষণ করে আমরা আবার চিঠি দিই। তাদের বক্তব্য ছিল, অনেক নথি মিসিং বা হারিয়ে গেছে। সেই তথ্য-উপাত্ত যদি খুঁজে পাওয়া যায় সেগুলো দাখিল করলে বকেয়া ভ্যাটের পরিমাণ কমবে। যদি না কমে তাহলে তারা (মেটলাইফ) সমুদয় অর্থ পরিশোধ করবে বলে ভ্যাট গোয়েন্দাদের জানিয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত অর্থ পরিশোধের কোনো মেসেজ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মেটলাইফ বাংলাদেশের (আলিকো) জনসংযোগ কর্মকর্তা (হেড অব কমিউনিকেশন) সাইফুর রহমান বলেন, প্রদেয় ভ্যাট পরিশোধের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। মেটলাইফ বাংলাদেশের আইন ও নীতিমালা একান্তভাবে অনুসরণ করে দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে দেশের মানুষকে বিমা সেবা দিয়ে আসছে।
ভ্যাট গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বেশকিছু দিন আগে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের গঠিত নিরীক্ষা দল আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের (আলিকো) নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির দলিলপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত বা ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি সামনে আসে। বিষয়টি তাদের অবগত করা হয়। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলিকো কর্তৃপক্ষের লিখিত ব্যাখ্যা এবং প্রাপ্ত দলিলপত্র পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সিএ ফার্মের অডিট রিপোর্ট এবং এজেন্সি অফিস এক্সপেন্সের (খরচ) ওপর উৎসে মূসক বা ভ্যাট প্রযোজ্য ছিল ১৩ কোটি ১৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৪১ টাকা। এর বিপরীতে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স পরিশোধ করেছে ১০ কোটি ৮৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩ টাকা। অপরিশোধিত বা ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ দুই কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৮ টাকা। এর সঙ্গে দুই শতাংশ হারে সুদ হিসাবে আদায়যোগ্য টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৫২ লাখ ৬৯ হাজার ২৮৫ টাকা। এ খাতে সুদসহ ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ দাঁড়ায় চার কেটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার ৭৮২ টাকা। ওই একই মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির এজেন্সি অফিস রেন্টের ওপর উৎস মূসক বা ভ্যাট বাবদ প্রযোজ্য টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় সাত কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৬৩৯ টাকা। যার বিপরীতে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটি পরিশোধ করেছে ছয় কোটি ৮০ লাখ ৪৪ হাজার ৪৬১ টাকা। অর্থাৎ ৮৯ লাখ ১৭৮ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে দুই শতাংশ হারে সুদ আসে ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার ২৩৯ টাকা। এজেন্সি অফিস রেন্টের ওপর সুদসহ ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৭ টাকা।
দুই খাতে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ফাঁকি দেয়া প্রকৃত ভ্যাটের পরিমাণ তিন কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৬ টাকা। এর সঙ্গে তিন কোটি আট লাখ ১৫ হাজার ৫২৪ টাকার সুদ যোগ করলে মোট ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় কোটি ৩১ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টাকা। এ বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পক্ষে দেয়া অপর এক চিঠিতে বলা হয়, অপরিশোধিত ভ্যাট বা মূসক যথাসময়ে পরিশোধ না করায় মূল্য সংযোজন কর ১৯৯১-এর ৩৭ ধারা অনুযায়ী ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদসহ মোট ছয় কোটি ৩১ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টাকা প্রতিষ্ঠানটির কাছে আদায়যোগ্য। যে কারণে মূসক আইন ১৯৯১ এর ৫৫ ধারার উপধারা ১ ও ৩ অনুযায়ী চিঠি দেয়া হয়েছে।
মেটলাইফ বাংলাদেশ দেশের সর্ববৃহৎ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মেটলাইফ কর্তৃক অধিগ্রহণের আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি আলিকো (অখওঈঙ) নামে পরিচিত ছিল। ২০১০ সালের নভেম্বরে বৈশ্বিক পর্যায়ে একত্রিত হয়ে এটি ‘মেটলাইফ- আলিকো’ নামে কো-ব্র্যান্ডেড হয় এবং ২০১৫ সালে এটি ‘মেটলাইফ’ নাম ধারণ করে। প্রচলিত ও নিত্যনতুন প্রোডাক্টের সমন্বয়ে, যেমন- ব্যক্তিগত ও গ্রুপ জীবন বিমা পলিসি, পেনশন স্কিম, সন্তানের শিক্ষা সুরক্ষা পলিসি, শরিয়াহ্ ভিত্তিক (তাকাফুল) সেভিং স্কিম এবং দুর্ঘটনা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পলিসির মাধ্যমে মেটলাইফ বাংলাদেশের জনগণকে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত নাম ‘আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি’।