চট্টগ্রাম বন্দরে ২৬৫ কনটেইনারে বিপজ্জনক পণ্য, খালাস নিতে অনাগ্রহ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০১ এএম, ১৩ জুন,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:২৯ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
চট্টগ্রাম বন্দরে ২৬৫টি কনটেইনারে রয়েছে বিপজ্জনক পণ্য। অধিকাংশ পণ্যই দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয়। কোনো কোনো পণ্য পড়ে রয়েছে ২০-২৫ বছর ধরে। আমদানি করার পর কোনো কারণে এসব পণ্য খালাস নেয়নি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর। তড়িঘড়ি করে এসব কনটেইনার দ্রুত সরিয়ে নিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকে চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিছু পণ্য নিলাম ও কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য ধ্বংস করার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই গত ৭ জুন দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর অভ্যন্তরে ছয় নম্বর শেডে একটি কনটেইনারে থাকা পুরোনো কেমিক্যাল নিচে পড়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করলে আতঙ্ক তৈরি হয়। খবরটি চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এরপর ঘটনাস্থলে যান কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। পরে জানা যায়, ধোঁয়া বের হওয়া কনটেইনারগুলো নিলামের জন্য রাখা। একটি পুরোনো মরিচা ধরা কনটেইনারের ভেতর থেকে কেমিক্যাল চুইয়ে নিচে পড়ে ধোঁয়া তৈরি করছে। বন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা ওই কনটেইনারটির মুখ খুলে একটি কেমিক্যালের জার বের করে দেখতে পান তাতে লেখা ইথাইল অ্যাসিটেট। এসব কেমিক্যাল ২০১০ সালে ভারত আমদানি করার পর থেকে বন্দরে পড়ে রয়েছে। এর আগে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পরদিন ৫ জুন তিন কনটেইনার হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড দ্রুত সরিয়ে নিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় বন্দর। ৬ জুন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের চালান স্পট নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ওইদিনই তিন কনটেইনারে থাকা ৩০ হাজার ৪৫০ কেজি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের চালানটি স্পট নিলামে বিক্রি করে কাস্টম। ৭ জুন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভর্তি একটি কনটেইনার খালাস নেয় নিলামকারী প্রতিষ্ঠান। অবশিষ্ট দুই কনটেইনার হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রবিবার (১২ জুন) নিলাম খালাস নেবে বলে জানান চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখার ডেপুটি কমিশনার আলী রেজা হায়দার। এরপর চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে আর কোনো হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকবে না বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
এদিকে গত ৭ জুন বন্দর অভ্যন্তরে কেমিক্যাল ভর্তি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার ঘটনার পরপরই কাস্টমকে আরেকটি চিঠি দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘কেমিক্যালসহ অন্যান্য পুরোনো পণ্যবাহী কনটেইনারের কারণে কোনো প্রকার দুর্ঘটনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।’ এরপর ওইদিনই (৭ জুন) একটি জরুরি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম কাস্টম। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড, প্রাইভেট কনটেইনার ডিপো ও বিমানবন্দর থেকে রাসায়নিক পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যভর্তি কনটেইনার নির্ধারিত সময়ে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের খালাস নিতে হবে। বন্দর ও ডিপো থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এবং বিমানবন্দর থেকে ২১ দিনের মধ্যে কিংবা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে পণ্য নিলামে তোলা হবে। তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৮ শতাংশ আমদানিপণ্য আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এরই মধ্যে বন্দরের ইয়ার্ড ও বিভিন্ন শেডে চার হাজার কনটেইনার পণ্য রয়েছে। বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোতেও রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার পণ্যভর্তি কনটেইনার। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে খালাস না হওয়া পণ্যের কনটেইনারও রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ২৬৫টি কনটেইনারের তালিকা দিয়েছে কাস্টমকে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের ভিতরে পণ্য রাখার ১৪টি শেড রয়েছে। এর মধ্যে পি-শেডে রাখা হয় বিপজ্জনক পণ্য। প্রায় ৩০ হাজার ৩৭৫ বর্গফুট আয়তনের এ শেড থেকেই এসব বিপজ্জনক পণ্য সরাসরি খালাস দেয়া হয়। আবার বন্দরে ইয়ার্ডগুলোতেও ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিপজ্জনক পণ্যবাহী কনটেইনার রাখা হয়। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, হাইড্রো ক্লোরাইড, সালফেট, কস্টিক সোডা, ওষুধের কাঁচামাল, রং তৈরির নানান কেমিক্যাল, টেক্সটাইল কেমিক্যাল, পারফিউমারি, ফিক্সিট সিলিকন, অ্যাস্ট্রোজেনসহ নানান ধরনের কেমিক্যাল পণ্য রয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় পদার্থ। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, বন্দর অভ্যন্তরে কেমিক্যালবাহী কনটেইনারসহ পুরোনো অনেক পণ্যের কনটেইনার রয়েছে। দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকা এসব পণ্য নিলামের জন্য কাস্টমকে বারবার তাগাদা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখার ডেপুটি কমিশনার আলী রেজা হায়দার বলেন, বন্দর থেকে ২৬৫টি বিপজ্জনক পণ্যবাহী কনটেইনারের তালিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমরা গত ৩১ মে ইনভেন্ট্রি শেষ করেছি। আমরা কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সার্ভারে যাচাই করে দেখেছি ২৮টি কনটেইনার পণ্য আমদানিকারকরা বিএলের (বিল অব লেডিং) মাধ্যমে খালাস নিয়ে গেছে। আবার তালিকায় থাকা ৪৪টি কনটেইনারের পণ্যের মেয়াদ নেই। এগুলো ধ্বংসযোগ্য। ৪১ কনটেইনার পণ্যের নিলাম চলমান। আগামী ২৮ জুন ২৮ লটে আরও ৪০টি কনটেইনারের পণ্য নিলামে তোলা হবে। তাছাড়া ৫৫টি কনটেইনার যাচাই করা হচ্ছে। এর মধ্যেও অনেকগুলো নিলামে তোলা হবে। অন্যগুলো ধ্বংস করা হবে। অসম্পূর্ণ তথ্য রয়েছে এমন ৫৭টি কনটেইনারের বিষয়েও কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, সনাতনী পদ্ধতিতে রেজিস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে নিলাম কার্যক্রম চলে। নিলামে অটোমেশন শুরু হলে ভবিষ্যতে জটিলতা অনেক কেটে যাবে। কাস্টমসের এ কর্মকর্তা বলেন, বন্দরে অনেক পুরোনো কনটেইনার রয়েছে। অনেক কনটেইনার নাড়ানোও সম্ভব নয়। ১০-১৫ বছরের পুরোনো কনটেইনার রয়েছে। তারপরও আগের অন্য সময়ের চেয়ে কাস্টমসের নিলাম কার্যক্রমে অনেক গতি এসেছে। পণ্য ধ্বংসের জটিলতার বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু বিপজ্জনক পণ্য রয়েছে, যেগুলো চাইলেও যত্রতত্র মাটিচাপা দিয়ে ধ্বংস করা যাবে না। মঙ্গলবার ধ্বংস কমিটির মিটিং রয়েছে। এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়া হয়েছে। বিএম কনটেইনারের দুর্ঘটনার পর থেকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিপজ্জনক কনটেইনারগুলো নিলাম কিংবা ধ্বংসের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। গত শনিবার (৪ জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। রাত ১০টার পর আগুনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১২টার পর থেকে মৃত্যু খবর আসতে থাকে। সময় যত গড়াতে থাকে মৃতের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। এ দুর্ঘটনায় সবশেষ ৪৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৪৬ জনের মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। এসব লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনো ১৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখনো আহত ৯৯ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, পার্কভিউ হসপিটালসহ ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটেও আহত অনেকে চিকিৎসাধীন। যাদের কয়েকজনের অবস্থা এখনো আশংকাজনক। নিহতদের শ্রম অধিদফতরের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে ১০৫ জনকে এরই মধ্যে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছে শ্রম অধিদফতর। তাছাড়া আহতদের ২৫ হাজার এবং নিহতদের দাফন-কাফনের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অন্যদিকে বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ, অঙ্গহানি হয়েছে এমন আহতদের ৬ লাখ এবং আহতদের ৪ লাখ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।