‘বিদ্যুৎ আসেনি, তবুও ভারতের আদানি গ্রুপ ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে ১২১৯ কোটি টাকা’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০৬ এএম, ৯ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:২৮ এএম, ১২ অক্টোবর,শনিবার,২০২৪
যে কাজের আর্থিক মূল্য নেই, সেটি অপচয়- মার্কিন শিল্পপতি হেনরি ফোর্ডের এই উক্তির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ যেন ভারতের আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চুক্তির বর্তমান অবস্থা। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় নেয়া উদ্যোগে আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ড প্রদেশের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যার বেশিরভাগটাই বাংলাদেশে রফতানি হবে।
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগস্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। তবে, এর সঞ্চালন লাইনটি এখনো প্রস্তুত নয় এবং ডিসেম্বরের আগে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ফলে বিদ্যুৎ পাওয়ার আগেই ওই কেন্দ্রের ভাড়া গোনা শুরু হবে। ‘আদানি গোড্ডা কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট : অ্যান অ্যাকিলিস হিল অব দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ মাসের ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) হবে ১৪১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার (১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা)। ২০১৭ সালে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বিশ্বের পঞ্চম ধনী ব্যক্তি আদানি গৌতম প্রতিষ্ঠিত আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ ৩ টাকা ২৬ পয়সা। তবে, বাংলাদেশে একই ধরনের প্ল্যান্টের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ২ টাকা ৮৩ পয়সা।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানি পাওয়ার ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৫ বছরের জন্য ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। মহামারির কারণে আদানি গ্রুপের কাজ শুরুর সময় অন্তত ৬ মাস পিছিয়েছে। আগামী আগস্টে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ দুটি প্রতিষ্ঠানের করা ওই গবেষণা।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানি পাওয়ার গোড্ডা থেকে ইন্টারকানেকশন পয়েন্ট পর্যন্ত ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন স্থাপন করবে। এই পয়েন্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের রোহনপুর সাবস্টেশন পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য ২২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। তবে, পিজিসিবি বলছে, বিদ্যুৎ আমদানির জন্য অবকাঠামো প্রস্তুত করতে আরও সময় প্রয়োজন। তা প্রস্তুত করতে অন্তত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে।
সঞ্চালন লাইনের প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান সরকার বলেন, সরঞ্জাম না আসায় সাবস্টেশনটি এখনো নির্মাণ করা যায়নি। আমরা আগামী বছরের প্রথম দিকে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ আমদানি করতে সক্ষম হবো। তবে তিনি দাবি করেন, ভারত অংশের সঞ্চালন লাইনও প্রস্তুত হয়নি। বিদ্যুৎ আমদানি না করেও ৪ মাসের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে, প্রতিবেদনের এমন তথ্যের বিষয়টি নিন্ডিত নন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, আমাদের কাজ তো শেষ। মনে হয় না, এটি (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হবে। কিন্তু এই বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি আমরা নিজেরাই তৈরি করে বিদ্যুৎ না নিতাম, তাহলেও আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হতো, বলেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ নেই, কোনো পেমেন্টও নেই’ সরকারের এই নীতি বড় আকারের স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমরা যদি এই নীতি অনুসরণ করি, তাহলে কেউই প্ল্যান্ট তৈরি করতে রাজি হবে না। যেহেতু আদানি বিনিয়োগ করবে, সেহেতু ন্যূনতম একটা পেমেন্ট তো তাদেরকে করতে হবে। আমাদের জন্য তারা প্ল্যান্ট বানাচ্ছে। যদি আমরা বিদ্যুৎ না নেই, তাহলে তো তারা সমস্যায় পড়বে, যোগ করেন তিনি। গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বিপিডিবি তার স্বাভাবিক ‘মেরিট অর্ডার ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতি অনুসরণ না করে ‘প্রায়োরিটি-বেসড ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতি অনুসরণ করবে। ‘মেরিট অর্ডার ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতিতে অল্প টাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কেন্দ্রগুলোকে আগে উৎপাদনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু ‘প্রায়োরিটি-বেসড ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতিতে আমদানিকৃত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রথমে দেশীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে নিষ্ক্রিয় রাখা হবে। এমনকি যদি তারা কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তবু প্রাধান্য পাবে আমদানি। বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেবট ও ভারত-ভিত্তিক গ্রোথওয়াচ এই যৌথ গবেষণাটি করে।
এতে বলা হয়, আদানি গোড্ডার বিদ্যুৎ আমদানিকৃত অন্যান্য বিদ্যুতের চেয়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ, আমদানিকৃত কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ ও দেশীয় কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি ব্যয়বহুল হবে।
সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, চুক্তির ২৫ বছরের মেয়াদকালের মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দিতে হবে বাংলাদেশকে, যা ৩টি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যথেষ্ট। পরিস্থিতি নেতিবাচক হলে, বিপিডিবিকে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৪২৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার (৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা) ও প্ল্যান্টের ২৫ বছরের মেয়াদকালে ১১ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ ৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা) দিতে হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার (ডলারপ্রতি ৯২ টাকা হিসাবে, ৩৫ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা), ঢাকা মেট্রোরেলে ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা) ও কর্ণফুলী নদীর টানেল নির্মাণে ব্যয় ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা)। পরিস্থিতি যদি ইতিবাচকও হয়, আদানি গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৩৩১ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার (২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা) দিতে হবে বাংলাদেশকে। সেটা ২৫ বছরে গিয়ে দাঁড়াবে ৮ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে (৮৪ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে আদানি পাওয়ারের বিনিয়োগ উঠে আসতে সর্বোচ্চ ৬ বছর ও সর্বনিম্ন ৪ বছর ৬ মাস সময় লাগবে। গবেষণা প্রতিবেদনটির লেখকদের একজন হাসান মেহেদী বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ভর করবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাপ্যতার (অ্যাভেইলেভিলিটি) ওপর। প্রতিবেদনটি তৈরির সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টরে (পিএলএফ) চলবে, এমনটা হিসেব করা হয়েছে। আর বিভিন্ন কারণে পিএলএফ ৫৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা ভারতের অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সর্বনিম্ন গড়।