বন্ধ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিন প্রস্তাব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৪ এএম, ২৪ মে,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৪০ এএম, ২৪ নভেম্বর,রবিবার,২০২৪
অনিয়ম-দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, ধারাবাহিক লোকসান ও অর্থপাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ১৬ আগস্টের পর আর কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে পারবে না বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন অথরিটি (পিআরএ)’ এবং ‘ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটির (এফসিএ)’ সোনালী ব্যাংক ইউকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংক ইউকে-কে এ নির্দেশ দেয়া হয়। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সেবা দিতে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যে কার্যক্রম শুরু করে সোনালী ট্রেড অ্যান্ড ফাইন্যান্স। পরে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের লাইসেন্স নিয়ে ২০০১ সালের তা ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। নাম দেয়া হয় সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড। প্রবাসী আয়ের সঙ্গে ঋণপত্রের নিশ্চয়তা দেয়া শুরু করে। পাশাপাশি ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ ও ঋণ কার্যক্রম চালু করে। এতেই ঘটে বড় দুর্ঘটনা। ব্যাংকটির মালিকানার ৫১ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের হাতে। আর ৪৯ শতাংশ সোনালী ব্যাংকের হাতে। কয়েক দফায় দেশ থেকে মূলধন জোগান দেয়ায় এখন সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের মূলধনের পরিমাণ ৬ কোটি ৩৮ লাখ পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ (প্রতি পাউন্ড ১০৯.২৮ পয়সা) ৬৯৭ কোটি টাকা। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৬ কোটি ডলার ঋণও দেয়া হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত বন্ধ করার নির্দেশনায় বাংলাদেশের সব বিনিয়োগই জলে পড়েছে যুক্তরাজ্যের মাটিতে। এখন সোনালী ব্যাংক ইউকে’র বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিষয়টির সুরাহা করতে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছে আর্থিক বিভাগ। দেয়া হয়েছে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আপিল, সোনালী ব্যাংক ইউকের পরিবর্তে যুক্তরাজ্যে দুটি অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ জন্য লাইসেন্স নিতে বাংলাদেশ থেকে আরো ১০ লাখ পাউন্ড মূলধন জোগান দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার-সংক্ষেপে বলা হয়, ২০১৬ সালে নন-কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সোনালী ব্যাংক ইউকের পাশাপাশি ব্যাংকটির তৎকালীন সিইও মো. আতাউর রহমান প্রধানকে (বর্তমানে তিনি সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন) তার দায়িত্বে অবহেলা, সুপারভাইজরি ঘাটতি ও অন্যান্য কারণে ৭৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড জরিমানা করে। ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর আতাউর রহমান প্রধানের বিরুদ্ধে আরোপিত শাস্তির সিদ্ধান্ত এফসিএ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকেই সোনালী ব্যাংক ইউকের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে ব্যাংকটি কেবল ট্রেড ফাইন্যান্স ও রেমিট্যান্স হাউজ হিসেবে সচল রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অর্থপাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি আতাউর রহমান প্রধানকে জরিমানা করা হলেও বাংলাদেশে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০১৬ সালে আতাউর রহমান প্রধানকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর ২০১৯ সালে তাকে সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে আতাউর রহমান প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে রয়েছেন। সোনালী ব্যাংক ইউকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সচিব মো. আসাদুল ইসলাম। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে ব্যাংকটির বিষয়ে তিনটি প্রস্তাব পাঠান।
প্রস্তাব- ১. ট্রাইব্যুনালে আপিল দায়ের : প্রস্তাবগুলোর একটি হচ্ছে পিআরএ’র বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আপিল দায়ের করা। তবে এ বিষয়ে বলা হয়, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এছাড়া আপিলে সোনালী ব্যাংক ইউকে মামলায় জয়ী হলেও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকবে। তাই ভবিষ্যতে এর সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা মোটেও সহজ হবে না। ট্রাইব্যুনালে আপিল ব্যর্থ হলে সোনালী ব্যাংক ইউকে ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের আর্থিক বাজারে কাজ করার জন্য কখনোই অনুমতি পাবে না।
প্রস্তাব- ২. কন্টিনজেন্সি প্ল্যান বাস্তবায়ন : কন্টিনজেন্সি প্ল্যান বাস্তবায়ন বিষয়ে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক ইউকে পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদিত কন্টিনজেন্সি প্ল্যান অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে ট্রেড ফাইন্যান্স ও রেমিট্যান্স ব্যবসা পরিচালনার জন্য সোনালী (ইউকে) লিমিটেড নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্যারেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে পৃথক দুটি অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে। বর্তমান শেয়ারহোল্ডাররা অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও সোনালী ব্যাংক ওই কোম্পানির শেয়ার ধারণ করবে। প্রস্তাবিত অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটি প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে পরবর্তী দুই-তিন বছর যথাযথ ব্যবসা পরিচালনা ও যাবতীয় রেগুলেটরি ইস্যুর প্রতিকার করবে এবং একটি শক্তিশালী অপারেটিং মডেল স্থাপন করে পরবর্তী সময়ে সোনালী ইউকে লিমিটেড ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য পুনরায় পিআরএ এবং এফসিএ’র কাছে আবেদন করবে। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে সোনালী ব্যাংক (ইউকে)-এর নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে সোনালী বাংলাদেশ ইউকে লিমিটেড নামীয় একটি নতুন অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করতে হবে, যা ট্রেডিংয়ের ওপর মনোযোগ দেবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় লোকবল, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া, প্লাটফর্ম সম্পদ-দায় ইত্যাদি বর্তমান কোম্পানির কাছ থেকে স্থানান্তর পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
প্রস্তাব- ৩. ব্যবসার পরিসমাপ্তি (এক্সিজ প্লান) : তৃতীয় বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংক ইউকে বন্ধ করে দিয়ে যুক্তরাজ্যে চলমান সব ব্যবসার পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। তবে এ পদ্ধতি অবলম্বন ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের বাজারে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রবেশকে আরো কঠিন করে তুলবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যুক্তরাজ্যে তাদের নিজস্ব একটি করেসপন্ডেন্ট ব্যাংক হারাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করে জানায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের স্বার্থে ১৬ আগস্টের পর যুক্তরাজ্যে এ ট্রেড ফাইন্যান্স ব্যবসা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় বিদেশি ব্যাংকগুলো এ ব্যবসা পুরো করায়ত্ত করবে এবং বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো অতিমাত্রায় বিদেশি ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংকগুলো নতুন ব্যাংকগুলোর জন্য ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট খুলতে অপারগতা প্রকাশ করবে, যা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্তরায় হবে।