পতনে নাকাল শেয়ারবাজার, দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:০৭ এএম, ২৩ মে,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৫৫ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের শেয়ারবাজার। আগের সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবারও দিনভর বড় দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এতে টানা আট কার্যদিবস পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় নাকাল দেশের শেয়ারবাজার। এ অবস্থায় বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই দিশেহারা। প্রতিদিনই শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমায় বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে। পতনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানিগুলোও। লোকসান কমাতে দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটানো হচ্ছে। এ দরপতনের পেছনে সরকারবিরোধী একটি চক্র সক্রিয়। তারা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। চলমান দরপতনের পেছনে যুক্তিসংগত কারণ নেই বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরাও।
তারা বলছেন, টানা দরপতনের কারণে ভালো মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ার দাম অবমূল্যায়িত হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত আতঙ্কিত না হয়ে ভালো কোম্পানি বাছাই করে শেয়ার কেনা। বাজার পর্যালোচনার দেখা যায়, গতকাল রবিবার লেনদেনের শুরুতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ে। এতে লেনদেনের ১০ মিনিটের মাথায় ডিএসই’র প্রধান সূচক ৩০ পয়েন্ট বেড়ে যায়। লেনদেনের শুরুতে এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকেনি। লেনদেনের প্রথম ১০ মিনিট বাদ দিলে পুরোটা সময় পতনের ধারায় ছিল শেয়ারবাজার। এমনকি লেনদেনের সময় যত গড়িয়েছে পতনের মাত্রা তত বেড়েছে। ফলে সূচকের বড় পতন দিয়ে দিনের লেনদেন শেষ হয়েছে।
দিনের লেনদেন শেষে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১১৫ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ১৪২ পয়েন্টে নেমেছে। আগের সাত কার্যদিবসে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক কমে ৪৪০ পয়েন্ট। আট কার্যদিবসের টানা পতনে ডিএসই’র প্রধান সূচক হারালো ৫৫২ পয়েন্ট। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক গতকাল রবিবার ৩৯ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ২৭৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ২১ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৬১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ২১টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৪৫টির। আর ১৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৬৮২ কোটি ২১ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৬৬৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন বেড়েছে ১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। শেয়ারবাজারের অব্যাহত দরপতন বিষয়ে ইব্রাহিম নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমি ২০১০ সালের ধস দেখেছি। সে সময় বড় ধরনের লোকসান দিয়েছি। এরপর কয়েক দফা উত্থান-পতন হলেও এমন অবস্থা আর দেখিনি। কোনো কিছুতেই কূলকিনারা করতে পারছি না। যা কিনছি তাতেই লোকসান। ২০১০ সালের পর এমন পরিস্থিতিতে আর পড়িনি।
দরপতন বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান দরপতন পরিকল্পিত। সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে সরকারবিরোধী চক্র পরিকল্পিতভাবে এ দরপতন ঘটাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আর একটি চক্রও সক্রিয়, যারা কম দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে।
তিনি বলেন, অতীতেও সরকারবিরোধী চক্র শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়েছে। সেই চক্র এখন আবার বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিএসইসি’র উচিত এ চক্রকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। বিএসইসি চাইলেই সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে পারে, কারা অস্বাভাবিক শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছে এবং কারা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের যে কথা বলা হচ্ছে, তা পুরনো ইস্যু। এ কারণে আমাদের শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে একটি বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে দেশের শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্কের কারণে শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। বাজারে ভালো-মন্দ সব ধরনের শেয়ারের দরপতন হয়েছে। অনেক ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার যৌক্তিক মূল্যের নিচে নেমে গেছে। আমি মনে করি, বিনিয়োগকারীদের উচিত প্রতিষ্ঠান বাছাই করে শেয়ার কেনা। তাহলে ভালো লাভ পাওয়া যাবে।
বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ বলছেন, ২০১০ সালের চেয়েও বড় লোকসানে পড়েছেন তারা। তবে কি শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের মতো নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে- এমন প্রশ্নে এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক বলেন, ২০১০ সালে ধসের আগে ভালো-মন্দ সব কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বেড়েছিল। বর্তমান বাজারে তেমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সুতরাং শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের মতো অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় কোনো কারণ নেই। এখন যে দরপতন হচ্ছে তা সাময়িক বলেই মনে হচ্ছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকা উচিত।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে যে দরপতন চলছে এর যুক্তিসংগত কোনো কারণ আমরা দেখি না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছে। আশা করি এটা খুব দ্রুত কেটে যাবে এবং আমরা ভালো বাজার পাব। এদিন পতনের বাজারে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার। কোম্পানিটির ৭০ কোটি ২৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ৩৯ কোটি ১৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৩৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বেক্সিমকো। এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং, স্যালভো কেমিক্যাল, জিএসপি ফাইন্যান্স, এসিআই ফরমুলেশন এবং শাহিনপুকুর সিরামিক। একইদিন দেশের অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ৩৬২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ১৭ কোটি ৩ লাখ টাকা। লেনদেন অংশ নেয়া ২৭৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টির দাম বেড়েছে। দাম কমেছে ২৪২টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৩টির শেয়ার দাম।