সরকারের বৃহৎ দুই প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:৪৭ এএম, ১২ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১১:৩৪ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সরকারের দুটি বৃহৎ প্রকল্পে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে বেপরোয়াভাবে। প্রথমটি রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট নিরসনে বাস র্যাপিড ট্রানজিট। ৪ বছর মেয়াদি প্রকল্পে ৮ বছরে অগ্রগতি ৩৭ শতাংশ। ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় প্রকল্প দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে খুলনার গোয়ালপাড়ায় ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। প্রকল্পটি ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্প্রসারণ। বছরের ৯ মাস বসে থাকে খুলনা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জানা গেছে, গতিহীন হয়ে পড়েছে রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট নিরসনে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। দফায় দফায় ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়েও গতি আনা যাচ্ছে না। চার বছরের এ প্রকল্প বিভিন্ন কারণে কয়েক ধাপে মেয়াদ বাড়িয়ে সাড়ে নয় বছর বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে আট বছর। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৭ শতাংশ। অপরদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে খুলনার গোয়ালপাড়ায় ২০১৩ সালে নির্মাণ করা হয় ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (নওপাজেকো) প্রথমদিকে বাস্তবায়িত এ কেন্দ্রটি চালু রাখা হতো বিদ্যুতের পিক সময়ে বিদ্যুৎ চাহিদার জোগান দিতে।
সূত্র জানায়, বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেটি না হওয়ায় প্রথম দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এরপর আরেক দফায় ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ সময় ব্যয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। করোনার কারণে আবারও সময় বাড়ানো হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালের জুনে। তবে যেভাবে ঢিমেতালে কাজ চলছে এতে বর্ধিত সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগের সাবেক সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘টাইম ওভার রান’ হলে অবশ্যই ‘কস্ট ওভার রান’ হবেই। অর্থাৎ সময় বাড়লে খরচ বাড়বেই। কেননা এ সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি হয়, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তা ছাড়া সাধারণত দুই বছর পরপর রেট শিডিউল পরিবর্তন হয়। এই ‘রেট শিডিউল’ পরিবর্তন হলে বেশ বড় অঙ্কের ব্যয় বেড়ে যায়। তবে এ প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির আর একটি কারণ হচ্ছে মূল ডিপিপিতে না থাকলেও পরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন পর্যন্ত পথচারী আন্ডারপাস যুক্ত করা হয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট অনুবিভাগ) নীলিমা আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, অনুমোদনের পর নানা কারণে প্রকল্পটির কাজ শুরু করতেই দেরি হয়েছিল। এ ছাড়া মাল্টি স্টেকহোল্ডারের কারণে বারবার ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়। সেই সঙ্গে এ প্রকল্পটিতে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেতু বিভাগ এবং সিটি করপোরেশনসহ একাধিক সংস্থা যুক্ত রয়েছে। তাই এটির বাস্তবায়ন বিলম্ব হলেও এখন কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে ভালোভাবেই কাজ এগিয়ে চলছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে লেখা আছে ৩৭ শতাংশ অগ্রগতি। তবে আমি মনে করি হিসাব-নিকাশ করা হলে এ হার দাঁড়াবে ৪৩ শতাংশে।
অপরদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে খুলনার গোয়ালপাড়ায় ২০১৩ সালে নির্মাণ করা হয় ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (নওপাজেকো) প্রথমদিকে বাস্তবায়িত এ কেন্দ্রটি চালু রাখা হতো বিদ্যুতের পিক সময়ে বিদ্যুৎ চাহিদার জোগান দিতে। পরবর্তী সময়ে এটির সক্ষমতা আরো ৭৫ মেগাওয়াট বাড়িয়ে নেয়ায় প্রকল্প শেষ হয় ২০১৭ সালে। তবে সক্ষমতা বাড়ানো হলেও খুব বেশি কাজে আসছে না সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প । গ্রীষ্ম মৌসুম ছাড়া বছরের নয় মাসই বসে থাকছে কেন্দ্রটি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তত্ত্বাবধানে থাকা নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুতের চাহিদা বিবেচনায় ২০১৭ সালে কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়। কিন্তু দেশে ওই সময়ে অনেকগুলো কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। ফলে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টে কেন্দ্রটি রূপান্তরিত হওয়ার পর তা খুব বেশি কাজে আসেনি। এখন বছরের নয় মাসই কেন্দ্রটি বসে থাকে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে গ্যাস ও তেল দুই ধরনের জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকলেও উৎপাদনের শুরু থেকেই তেল দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ আর্থিক চাপের মুখে ফেলছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদনে (পিসিআর) দেখা গেছে, গ্যাস না থাকায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় ইউনিট প্রতি ১৬ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।
জানা গেছে, এনডব্লিউপিজিসিএল তত্ত্বাবধানে গোয়ালপাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক সমিতির নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। সিঙ্গেল সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের কেন্দ্রটি উৎপাদনে যায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করে এডিবি, বাংলাদেশ সরকার এবং এনডব্লিউপিজিসিএল। এরপর ২০১৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর সিম্পল সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসে। এরপর ২০১৫ সালের শেষের দিকে দেশের সব সিঙ্গেল সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টকে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে খুলনার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আপগ্রেড করা হয়। গ্যাস টারবাইন প্রকল্পের সঙ্গে স্টিম টারবাইন যোগ করে আরো ৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়। ফলে কেন্দ্রটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ২২৫ মেগাওয়াটে। ২০১৬ সালের ২৫ জুন কম্বাইন্ড সাইকেল হিসেবে উৎপাদনে আসে। ৭৫ মেগাওয়াট যুক্ত করতে এ প্রকল্পে আরো ৮৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুতের বেশকিছু কেন্দ্র উৎপাদনে এলে অতিরিক্ত এ বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, কম্বাইন্ড সাইকেল সিস্টেমে রূপান্তরিত হওয়ার সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস ও তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু গত ২০১৬ সালের পর থেকে কেন্দ্রটি দু-তিন মাসের বেশি প্রয়োজন হয়নি। এছাড়া গ্যাস সংযোগ না থাকায় ডিজেল দিয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
গ্যাস সংযোগের বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, খুলনায় সে সময় গ্যাস সংযোগ আসবে এমন সম্ভাবনা থেকেই কেন্দ্রটি ডুয়েল ফুয়েল সিস্টেম রাখা হয়। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না থাকায় যেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হয়েছিল, তা এখন প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। এখন খুলনায় গ্যাস এসেছে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংযোগ পেতে হলে কমিশনিং করতে হবে। তিনটি দেশ মিলে এ কমিশনিং করে। আমরা তাদের অনেক আগেই প্রস্তাব দিয়েছি। চলতি মাসে তারা কমিশনিং করতে চেয়েছে কিন্তু কভিডের কারণে তারা এখন কেউ বাংলাদেশে আসতে চাইছে না।
এভাবে দেশের বৃহৎ দুই প্রকল্প নিয়ে অর্থ, যোগান, সময় সব ক্ষেত্রেই হযবরল অবস্থায় আছে। বর্তমান নির্ধারিত সময়েও যদি প্রকল্পগুলোর সমাধান না করা যায় সেক্ষেত্রে আগামী আরও ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে প্রকল্প।