বিতর্ক ছড়াচ্ছে মোংলা বন্দরের ‘বারভিডা লেভি’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৩২ এএম, ১৮ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৪৫ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামুদ্রিক বন্দর মোংলায় আমদানি ও রফতানি কাজে গতি ফেরাতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ বেশ সাড়া ফেলেছে। এমন সার্ভিসে দীর্ঘদিন পর মোংলা বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে দাবি ব্যবসায়ীদের। তবে, ওয়ান স্টপ সার্ভিসে নতুন একটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ‘বারভিডা লেভি’ নামের এক ধরনের চার্জ আদায় থেকে এ বিতর্কের জন্ম। আমদানি গাড়িপ্রতি এক হাজার টাকা ‘লেভি’ আদায়ে মোংলা বন্দরে রয়েছে পৃথক ডেস্ক। যদিও শুধুমাত্র বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)-এর সদস্যদের ক্ষেত্রে ‘বারভিডা লেভি’ আদায় হচ্ছে।
জানা যায়, বারভিডা সদস্যদের দেয়া হাজার টাকার মধ্যে ৯০০ টাকা সংগঠনটির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। বাকি ১০০ টাকা যায় মোংলা বন্দরের কর্মচারী ওয়েলফেয়ার ফান্ড নামের একটি হিসাবে। অভিযোগের সূত্র এ জায়গা থেকেই। একটি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে অর্থ আদায় এবং নিজেদের হিসাবে অর্থ জমা রাখা কতটুকু আইনসিদ্ধ, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এটা করতে পারে কি না এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ‘বারভিডা লেভি’। বারভিডা লেভির নামে বছরে কোটি কোটি টাকা আদায় ও লুটপাট হচ্ছে এমন এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত ৩০ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। দুদকের খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে ওই অভিযানে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়।
অভিযান সংশ্লিষ্ট দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বারভিডার মতো একটি বেসরকারি সংগঠন তাদের সদস্যদের কাছ থেকে ওয়েলফেয়ার ফি নিতে পারে। এটা নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমাদের আপত্তি দুটি বিষয়ে। প্রথমত, বারভিডা ‘লেভি’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারে কি না। কারণ, লেভি শব্দটি দিয়ে ‘শুল্ক’ বোঝায়।
অন্যদিকে, তারা নিজস্ব ফি আদায়ে বন্দর ব্যবহার করছে। এছাড়া বন্দর ও বারভিডার মধ্যে কোনো লিখিত সমঝোতা চুক্তিও পাওয়া যায়নি অভিযানকালে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের মতো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে একটি সংগঠনের হয়ে কাজ করে এবং আইনি ফ্রেমের বাইরে অর্থ আদায়ে সহযোগিতা করে। একই সঙ্গে আদায় করা বারভিডা লেভির একটি অংশ আবার বন্দরের ওয়েলফেয়ার ফান্ড নামের একটি হিসাবে জমা হয়। বারভিডা সদস্যদের দেওয়া হাজার টাকার মধ্যে ৯০০ টাকা সংগঠনটির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। বাকি ১০০ টাকা যায় মোংলা বন্দরের কর্মচারী ওয়েলফেয়ার ফান্ড নামের একটি হিসাবে। অভিযোগের সূত্র এ জায়গা থেকেই। একটি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে অর্থ আদায় এবং নিজেদের হিসাবে অর্থ জমা রাখা কতটুকু আইনসিদ্ধ, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এটা করতে পারে কি না এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ‘বারভিডা লেভি’ অভিযানকালে দুদক টিমকে ওই ফান্ডের লেনদেনের যথাযথ হিসাব দিতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ, বলেন ওই কর্মকর্তা।
বারভিডা লেভি আদায় আইনসিদ্ধ এবং সরকারের অনুমতি নিয়েই এটি করা হচ্ছে এমন দাবি করে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট আবদুল হক বলেন, বারভিডা তাদের সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গাড়িপ্রতি এক হাজার টাকা নেয়। যা বারভিডার সাধারণ সভায় পাস করা। শুধু এজিএমে নয়, সরকার কর্তৃক এটি অনুমোদিত। একটি অংশ আমাদের ওয়েলফেয়ার ফান্ডে এবং অপর একটি অংশ বন্দরের ওয়েলফেয়ার ফান্ডে যাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় এটি আদায় করে ৯০০ টাকা সংগঠনের হিসাবে এবং বাকি ১০০ টাকা বন্দরের ওয়েলফেয়ার ফান্ডে জমা হচ্ছে। আমরা যা নিচ্ছি তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত। বারভিডা হচ্ছে মোংলা বন্দরের অন্যতম স্টেক হোল্ডার। রাজস্বের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অর্থ আত্মসাতের কোনো প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে দুদক কিছু করতে পারে না। কারণ, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। যেহেতু এটি সরকারি বিষয় নয়, তাই তাদের তফসিলভুক্তও নয় বলে দাবি করেন বারভিডা প্রেসিডেন্ট।
দুদকের ওই অভিযানের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, সরকারি অর্থ আত্মসাতের হাজারও অভিযোগ রয়েছে। সে বিষয়ে তেমন কোনো কার্যক্রম দেখি না। কিন্তু একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ভালো কাজ করছে, সেখানে কেন দুদক? আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
নাম প্রকাশ না করে বারভিডার এক সদস্য বলেন, অনিয়মের কারণে আমাদের সংগঠনের এক সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি-ই নানা অভিযোগ দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করছেন। অথচ তার কাছ থেকে লেভি আদায় করা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটা নিয়ে তিনি মামলাও করেছেন। সেই মামলার কারণে লেভির কার্যক্রম স্থগিত আছে। এখন তা সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায়। বহিষ্কার করা নিয়েও তিনি মামলা করেছেন। সেই মামলা ইতিমধ্যে খারিজ হয়ে গেছে।
দুদক যা বলছে : দুদকের অভিযান সম্পর্কে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশে আমদানি করা পণ্য আটকে রেখে বেআইনিভাবে অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ ডিসেম্বর অভিযান পরিচালনা করে এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযোগ যাচাই ও সত্য উদঘাটনে জন্য মোংলা বন্দর পরিদর্শন করা হয়। টিম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। বন্দর পরিদর্শনকালে বারভিডা কর্তৃক গাড়িপ্রতি লেভি বাবদ অর্থ আদায়ের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। ওই অর্থের একটা অংশ বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এ অর্থ ব্যয়ের কোনো সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। বারভিডা কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে গাড়িপ্রতি অর্থ আদায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বর্তমানে বন্ধ আছে। অভিযানে প্রাপ্ত নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দাখিল করলে পুরো বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মচারী ওয়েলফেয়ার ফান্ডে অর্থ যাওয়ার বিষয়টি ‘দোষের কিছু নয়’ বলে মনে করেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, টাকা আমরা আদায় করি না। বারভিডা আদায় করে। এর সঙ্গে মোংলা বন্দরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বারভিডার মতো ব্যবসায়ী সংগঠন যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং সরকার যদি অবহিত থাকে তাহলে কোনো দোষ আছে বলে মনে হয় না। তবে বারভিডার মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা আছে কি না, সেটা আমরা বলতে পারব না। বারভিডা ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার এ বিষয়ে জানা নেই। আমরা যতটুকু জানি, বারভিডা অর্থ আদায় করে তাদের ফান্ডে জমা রাখে। এরপর ওই টাকা তারা কী করে, সেটা তাদের বিষয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কিসের ভিত্তিতে ১০০ টাকা গ্রহণ করছে এমন প্রশ্নের জবাবে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বারভিডা আমাদের পোর্ট ব্যবহার করছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা চার্জ নিতেই পারি। আদায় করা টাকা আমাদের ফান্ডে থাকে। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে আমরা তা কর্মচারীদের কল্যাণে খরচ করি।
অভিযোগে যা আছে : বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)-এর সদস্যদের আমদানি করা গাড়ি থেকে বন্দরের গুদাম ভাড়ার পাশাপাশি অবৈধভাবে ‘বারভিডা লেভি’ নামক অবৈধ শুল্ক ধার্য করে জোরপূর্বক অর্থ আদায় হচ্ছে। বছরে এ অর্থ আদায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি টাকা। সংগঠনটির হিসাবে এ অর্থ জমা করে নিজেদের মধ্যে তা ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। সরকারি সব শুল্ক-কর, বন্দরের গুদাম ও মাশুল দেয়ার পরও ‘বারভিডা লেভি’ নামে গাড়িপ্রতি এক হাজার টাকা অতিরিক্ত অর্থ না দিলে আমদানি করা গাড়ির খালাস বন্ধ হয়ে যায়। এক হাজার টাকার মধ্যে বারভিডা ৯০০ টাকা আর বন্দরের সংশ্লিষ্টরা ১০০ টাকা ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, কোম্পানি আইন ১৯৯৪ ও বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর বিধান অনুযায়ী, বারভিডার মতো কোনো বাণিজ্যিক সংগঠন তার সদস্যদের আমদানি করা গাড়ি (পণ্য) জিম্মি করে শুল্ক বা চাঁদা আদায় করতে পারে না। বারভিডা শুধুমাত্র সদস্যদের কাছ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত বার্ষিক নবায়ন ফি আদায় করতে পারে। আর বন্দর আইন ১৯০৮ ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর বিধান এবং সরকারি অন্যান্য গেজেট নোটিশের মাধ্যমে প্রকাশিত বিধিবিধান অনুযায়ী কোনো বেসরকারি সংগঠনের পক্ষে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এমন অবৈধ চাঁদা আদায় করতে পারে না। বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু গেজেটে প্রকাশিত ও আইনগতভাবে স্বীকৃত শুল্ক আদায় ব্যতীত অন্য কোনো বেসরকারি সংগঠনের পক্ষে অবৈধ শুল্ক বা চাঁদা আদায় করা কিংবা উক্ত বেসরকারি সংগঠনকে বন্দরের অভ্যন্তরে অবৈধ চাঁদা আদায় করার অনুমতি দিতে পারে না, বলা হয় অভিযোগপত্রে।