দেশ থেকে অর্থ পাচার থামছে না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩৬ এএম, ৩০ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০২:০৮ পিএম, ২ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
অর্থ পাচার থামছে না। দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। আমদানি-রফতানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অঙ্কটি বড়ই হচ্ছে। গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১১ লাখ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটি ঘটনায় মাত্র ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। কারণ হিসেবে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অবশ্য জিএফআইয়ের তথ্য আস্থায় নিতে রাজি নন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থ পাচারের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। বর্তমানে এমন অনেক খাতে অর্থ পাচার হচ্ছে, যা জিএফআই আমলে নেয় না।
বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বছরে বাংলাদেশ থেকে গড়ে আট দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে বলে জানিয়েছে জিএফআই।
সংস্থাটি জানায়, ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ৮৬ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সোয়া চার লাখ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এক দশকে বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৩৪টি দেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে এক দশমিক ছয় ট্রিলিয়ন বা এক লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। বাণিজ্যের আড়ালে এভাবে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে চীন থেকে। এরপরই তালিকায় আছে পোল্যান্ড, ভারত, রাশিয়া ও মালয়েশিয়া। ১৩৪টি দেশের দেয়া যেসব তথ্য জাতিসংঘের ডেটাবেজে পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে জিএফআই। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ডেটা পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালের পর থেকে এভাবে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
জিএফআইয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৪২৬ কোটি মার্কিন ডলার। একই ধারায় ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি, ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি এবং ২০১৫ সালে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়। এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছিল, বিগত বছরগুলোতে অর্থ পাচারের ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে। আগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছিল, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাচার হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৬ বছরে যে পরিমাণ অর্থ পাচারের কথা বলা হচ্ছে, তা সর্বশেষ দুই অর্থবছরের মোট বাজেটের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি এবং আগের অর্থবছরে বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া পাচারের এই অর্থ দেশের বর্তমান জিডিপির ৩১ শতাংশ। বর্তমানে জিডিপির আকার ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার না হলে দেশে বর্তমানে জিডিপির আকার ছাড়িয়ে যেত সাড়ে চার শ বিলিয়ন ডলারে।
অনেকে তুলনা করে বলছেন, পাচারের এই টাকা দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো যেত। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম অংশ মেট্রোরেলই বা কতগুলো বানানো সম্ভব ছিল, এ হিসাবও কষছেন কেউ কেউ। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা। পাচারের এই অর্থ দিয়ে দেশের বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত খুব সহজেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারে যে তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করছে, সেটাও আংশিক। বাস্তবে পরিমাণ আরো অনেক বেশি। অনেক বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন। তারা আয়ের বড় একটা অংশ অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। এটাও অর্থ পাচার। এই তথ্য কিন্তু বৈশ্বিক সংস্থাগুলো উল্লেখ করে না। তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের তথ্য দেয়। তিনি আরো বলেন, যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা গেলে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও ফেরত আনা যেত। এখানে আমাদের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে। তবে আইনে যে ঘাটতি নেই তা আমরা ২০০৭ সালে দেখেছি। তখন সিঙ্গাপুর থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারে গ্লোবাল সংস্থাগুলো যে তথ্য দিয়ে থাকে, সেগুলো সঠিক নয়। এগুলোর কোনো যৌক্তিকতাও নেই। এ বিষয়ে তারা কখনো নথিপত্রও দিতে পারেনি। অনুমানের ভিত্তিতে কথা বললে তো হবে না। মন্ত্রী আরো বলেন, আমরা টাকা পাচারের জন্য আইন করিনি। কেউ যাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বা টাকা বিদেশে পাচার না করে, সে জন্যও দেশে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে দেশে বৈধভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার জনগোষ্ঠী এখন বৈধভাবে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করছে। দেশেই টাকা বিনিয়োগ করছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ায় এখন আর টাকা পাচার হয় না। বরং দেশেই বিনিয়োগ হয়। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, এরপরও অর্থ পাচারের তদন্তে দেশে একাধিক সংস্থা কাজ করছে। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে মামলা করে থাকে। দুদকের মামলায় এখন অনেকেই জেলে আছে। সরকার অর্থ পাচার রোধে সব সময় তৎপর আছে বলেও দাবি করেন তিনি।