রাশিয়া থেকে সরকারিভাবে আনা ৫টি জাহাজে সাড়ে ১৩ কোটি টাকার গম হাওয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৩২ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:১৭ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
সরকারের আমদানিকৃত কোটি কোটি টাকার গমের হদিস নেই। এই গম কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছে বা আদৌ আনা হচ্ছে কি না তা কেউ নিশ্চিত হতে পারছেন না। গম আমদানি খাতে সংঘবদ্ধ একটি চক্র সক্রিয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পাঁচটি মাদার ভ্যাসেলে সাড়ে ১৩ কোটি টাকার গম হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় গতকাল একটি মাদার ভ্যাসেলের চট্টগ্রাম ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি।
সূত্রে জানা যায়, সরকার রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ২২০ টন গম আমদানি করছে। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে ৬টি মাদার ভ্যাসেলে আনা হচ্ছে ২ লাখ ৯১ হাজার ২২০ টন এবং ইউক্রেন থেকে দুটি মাদার ভ্যাসেলে আনা হচ্ছে ১ লাখ ৫ হাজার টন। রাশিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রোডিনটর্কের সাথে চুক্তির আওতায় গ্রেন এক্সপোর্ট নামের সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান গমগুলো সরবরাহ দিচ্ছে। তাদের এদেশীয় এজেন্ট হচ্ছে ন্যাশনাল ইলেকট্রিক বিডি লিমিটেড। ৬ অক্টোবর তাদের প্রথম জাহাজটি ৫৪ হাজার ৫০ টন গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। এমভি আকিজ মুন নামের এই জাহাজ কুতুবদিয়ায় লাইটারেজ জাহাজ, চট্টগ্রাম সাইলো জেটি এবং মোংলা বন্দরে গম খালাস করে।
কিন্তু খালাস শেষে দেখা যায়, এই জাহাজে ৮৩৮.৫২৮ টন গম কম ছিল। এরপর ১১ অক্টোবর এমভি পেনরমেটিস নামের অপর একটি জাহাজ ৪২ হাজার টন গম নিয়ে বহির্নোঙরে পৌঁছে। এই জাহাজটি বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজে গম খালাস করে ড্রাফট কমিয়ে সাইলো জেটিতে এসে বাকি গম খালাস করে। খালাস শেষে এই জাহাজেও ৮৭৬.৯৮৮ টন গম কম পাওয়া যায়। সরকারিভাবে আমদানিকৃত তৃতীয় চালান ৩৫ হাজার ২৫০ টন গম নিয়ে এমভি ভেসলেটস নামের জাহাজটি ১৩ অক্টোবর সরাসরি সাইলো জেটিতে বার্থিং নেয়। এই জাহাজের গম খালাস শেষে দেখা যায়, ৬৭৮.২৭০ টন গম হাওয়া হয়ে গেছে। চতুর্থ জাহাজ হিসেবে এমভি ইউনিভার্সেল ব্রেমেন ২৩ অক্টোবর ৫৪ হাজার ২৫০ টন গম নিয়ে বহির্নোঙরে পৌঁছে। এই জাহাজও লাইটারেজ জাহাজ, চট্টগ্রামের সাইলো এবং মোংলায় গম খালাস করে। খালাস শেষে এই জাহাজটিতেও ৯৯৫.০০৩ টন গম কম পাওয়া যায়। পঞ্চম জাহাজ এমভি আকিজ গ্লোব ৫১ হাজার ৭০০ টন গম নিয়ে পৌঁছে ৫ নভেম্বর। জাহাজটি থেকে ৩১ হাজার ২০ টন গম চট্টগ্রামে, বাকি ২০ হাজার ৬৮০ টন গম মোংলা বন্দরে নামানোর কথা। গতকাল চট্টগ্রামের ৩১ হাজার ২০ টন গম খালাস শেষে দেখা যায় ৯৭৫.০৬৬ টন হাওয়া হয়ে গেছে। মোংলায় গম খালাসের পর হাওয়া হয়ে যাওয়া গমের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, পাঁচটি জাহাজে মোট ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৫০ টন গম আমদানি করা হলেও ইতিমধ্যে ৪৩৬৩.৮৫ টন গম হাওয়া হয়ে গেছে। প্রতি টন গমের আমদানি মূল্য ৩৫০ ডলার। এই হিসেবে হাওয়া হয়ে যাওয়া গমের মূল্য ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি। পঞ্চম জাহাজ থেকে মোংলায় গম খালাস শেষে হাওয়া হয়ে যাওয়া গমের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকারিভাবে আমদানিকৃত গম সরকারি নিয়ন্ত্রণে খালাস করা হলেও গম কোথায়, কীভাবে চলে যাচ্ছে তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, জাহাজীকরণের সময় গম কম দেয়া হচ্ছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র কৌশলে কোটি কোটি টাকার গম হাওয়া করে দিচ্ছে। সরকারি গুদামে গম গ্রহণ করা হচ্ছে। সাইলোতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে গম রিসিভ করা হয়। সেখানে প্রযুক্তিগত সমস্যায় পয়েন্ট ৫ শতাংশ পর্যন্ত যোগ-বিয়োগ হতে পারে। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ গম হাওয়া হয়ে যাওয়ার সুযোগ সাইলোতে নেই বলে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
তারা বলেছেন, ইতিপূর্বে এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হলে সাইলোর গম গ্রহণ এবং সংরক্ষণের ব্যাপারে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর একটিতে পয়েন্ট ০৫ শতাংশ কম এবং অপর তদন্তে ১০৯ টন গম বেশি পাওয়া গিয়েছিল। উক্ত হিসেবের গোলমালের জন্য চারজন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল।
সরকারি প্রতিষ্ঠান সাইলোতে একেকটি জাহাজ থেকে শ শ টন গম গায়েব করে দেয়ার সুযোগ নেই, সম্ভবও নয় মন্তব্য করে চট্টগ্রামের খাদ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, কোটি কোটি টাকার গম কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে যাচ্ছে তা আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংঘবদ্ধ কোনো চক্র এর পেছনে কীভাবে কাজ করছে তা খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে উঠেছে। সরবরাহের আড়ালে কোনো চক্র এই কারসাজিতে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
গম কম পাওয়ার কথা স্বীকার করে চট্টগ্রাম সাইলো সুপার ফয়েজ উল্ল্যাহ খান শিবলী বলেন, ‘আমরা সরবরাহকারী, শিপিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উপস্থিতিতে গম খালাস করি। এতে কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। কীভাবে, কোথায় এবং কেন জাহাজের গম কমে যাচ্ছে তা আমরা জানি না। তবে আমরা যা গ্রহণ করছি তা সরকারকে জানিয়ে দিচ্ছি। এর বাইরে কোথায় কী হচ্ছে তার দায়-দায়িত্ব আমাদের নেই।’