কমেছে রেমিটেন্স
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩:১৫ এএম, ২২ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৪৪ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
দেশে রেমিটেন্স আসা বছরজুড়ে কমেছে। সর্বশেষ গত নভেম্বও মাসের রিপোর্টেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে গত মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হলে বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে বিদেশের শ্রমবাজার অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে দেশে র্যামিটেন্স প্রবাহে বড় ধাক্কা লাগে। এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত। গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি কর্মী গেছে বিভিন্ন দেশে। আগের বছরের তুলনায় ছয় মাস ধরে প্রতি মাসেই কর্মী পাঠানো বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে কমেছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। এটি বাড়াতে হলে আনুষ্ঠানিক খাতে টাকা পাঠানো আরও উৎসাহী করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত বছর কাজ নিয়ে বিদেশে যান ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৬৯ জন। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাস পুরোপুরি বন্ধ ছিল বিদেশে যাওয়া। এ বছরের শুরু থেকে বাড়তে থাকলেও মাঝে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে এপ্রিল-মে ও জুলাই-আগস্টে কমে যায় প্রবাসে কর্মসংস্থান। সব মিলে প্রথম ১১ মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন। বছর শেষে এটি সাড়ে ৫ লাখ ছাড়াতে পারে।
বিএমইটি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৮ হাজার ৫৩ জন। একই সময়ে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এ বছর একই সময়ে গেছেন ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৫৩ জন। এবারের ছয় মাসে কর্মসংস্থান ব্যাপক বাড়লেও প্রবাসী আয় এসেছে ৮৯ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে ২ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ কর্মী পাঠানো বাড়লেও প্রবাসী আয় কমেছে ১৮ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে বৈধ পথে কর্মী পাঠানোয় গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এবারের অভিবাসী দিবসে স্লোগান ঠিক করা হয়েছে ‘শতবর্ষে জাতির পিতা, সুবর্ণে স্বাধীনতা; অভিবাসনে আনব মর্যাদা ও নৈতিকতা’। তবে বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সূত্র বলছে, বিদেশের শ্রমবাজার ঘিরে নানা শঙ্কার মধ্যে নতুন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দক্ষ কর্মী তৈরির বিকল্প নেই। অভিবাসন খরচ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এতে করে বৈধ পথে বা নৈতিক অভিবাসনের বিস্তৃতি বাড়বে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন গনমাধ্যমকে বলেন, বিদেশে কর্মসংস্থান স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে। কয়েক মাস পর থেকে প্রবাসী আয়েও প্রভাব পড়বে। প্রবাসী আয় বাড়াতে যেকোনো উপায়ে বৈধ চ্যানেলকে উৎসাহী করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অভিবাসীর মর্যাদা নিশ্চিত করতে নৈতিক অভিবাসন, সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হচ্ছে।
প্রবাসী আয় কমাচ্ছে ‘হুন্ডি’:
নভেম্বরে যে প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় এলে অতিরিক্ত ২ শতাংশ প্রণোদনা বহাল আছে। তবে অবৈধ পথে এলে আরও বেশি অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের মূল্য ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা হলেও খোলাবাজারে ডলার ৯০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার এমন শঙ্কা থেকেই চলতি বাজেটের আগে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা ২ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিল প্রবাসী মন্ত্রণালয়, যা আমলে নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারি শুরুর পর উড়োজাহাজ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অবৈধ পথে আয় আসাও বন্ধ হয়। এতে প্রবাসী আয়ে নতুন নতুন রেকর্ড হয়। এখন যোগাযোগব্যবস্থা চালু হয়েছে, কর্মী যাওয়া বাড়ছে। প্রবাসী আয়ও কমতে শুরু করেছে। বেসরকারি খাতে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা বলছেন, বিদেশে মাত্র ২ শতাংশ কর্মী গেছেন সরকারি ব্যবস্থাপনায়। বেসরকারি খাতেও নতুন কর্মীদের জন্য অধিকাংশ ভিসা সরবরাহ করেন প্রবাসী কর্মীরা। রিক্রুটিং এজেন্সি প্রক্রিয়াগত কাজ করে। এতে প্রতিটি ভিসা নিয়ে একটি বাণিজ্য হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে একটি ভিসা নিতে অন্তত ৫০০ মার্কিন ডলার বা ৪৫ হাজার টাকা লেনদেন হয়। বৈধ পথে বিদেশে টাকা পাঠানোর সুযোগ না থাকায় এ টাকা বিদেশে যায় হুন্ডির (অবৈধ লেনদেন) মাধ্যমে। তাই বৈধ পথে টাকা পাঠানোর সুযোগ দিতে হবে; না হলে ভিসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত বছর প্রবাসীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়েনি। এর প্রভাবে আয় কিছুটা কমতে পারে। এ বছর যাওয়া বাড়লেও তার সুফল পেতে সময় লাগবে। এ ছাড়া বাণিজ্য, বিদেশে আসা-যাওয়া ও পর্যটন চালু হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক খাতে লেনদেন বেড়েছে। ২ শতাংশ প্রণোদনার চেয়েও খোলাবাজারে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ডলারের দাম। প্রণোদনা বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে সরকার।
দক্ষ কর্মী বাড়াবে নৈতিক অভিবাসন :
এদিকে জানুয়ারি থেকে খুলতে পারে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে কয়েকদিন আগে। গতকাল প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন কওে বলেছেন আগামী জানুয়ারী মাস থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো যাবে। তিনি বলেন এক লাখেরও কম টাকায় এবার মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে। তাই তিনি দালালদেও কাছে না যেতে প্রবাসীদেও প্রতি আহবান জানিয়েছেন। গত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সাম্প্রতিক সময়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে আছে। ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে ওই সময়। এবারও একই আশঙ্কা করছেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, মালয়েশিয়ার একটি চক্রের যোগসাজশে আবারও দেশীয় চক্রটি এ বাজার নিয়ন্ত্রণের পাঁয়তারা করছে। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের অর্থনীতি ভালো হওয়ায় অনেকে বাড়তি টাকা দিয়ে যেতে চায় না। এতে আগের চেয়ে অভিবাসন খরচ কিছুটা কমেছে। দক্ষ কর্মীরা অনৈতিক উপায়ে যায় না, তাই দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারলেই নৈতিক অভিবাসন নিশ্চিত হবে। আর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যাতে আবারও কোনো চক্রের কাছে জিম্মি না হয়ে পড়ে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।