বিমা কোম্পানিগুলোর শতকোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:২৫ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
পরিবহনের ক্ষেত্রে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দিয়েছে সরকার। এতে দেশে ব্যবসা করা সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর বছরে হাতছাড়া হচ্ছে শতকোটি টাকার বেশি। একই সঙ্গে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে আবারও পরিবহনে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর অধীনে ১৫৫ ধারায় ছিল দন্ডের বিধানও। তবে নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ওই বছরের ডিসেম্বরে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেয় বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এর পর থেকেই মূলত মালিকরা পরিবহনের বিমা করা প্রায় বন্ধ করে দেন। বর্তমানে যেসব পরিবহন চলাচল করছে তার সিংহভাগেরই কোনো বিমা নেই। বিশেষ করে বিমা ছাড়াই চলাচল করছে মোটরসাইকেল।
বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমা ছাড়া পরিবহন চলাচল করে এটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এটা এক ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ফলে বিমা কোম্পানিগুলো যেমন বড় অঙ্কের ব্যবসা হারাচ্ছে তেমনি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। পাশাপাশি সড়কে বাড়ছে ঝুঁকি। কারণ তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা থাকা পরিবহন কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পেতোই। কিন্তু এখন বিমা না থাকায় কেউ কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয়ের ১০-১২ শতাংশই আসতো মোটর বিমা থেকে। যার বড় অংশই মোটরসাইকেল বিমা। আর মোটরসাইকেলের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ তৃতীয়পক্ষের হওয়ার কারণে এসব বিমার পক্ষে কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধনের পরিমাণও বেশ কম। ফলে মোটর বিমার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই কোম্পানিগুলোর মুনাফা হিসেবে থেকে যেত। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশে ব্যবসা করা সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো মোটরযান বিমা থেকে নিট প্রিমিয়াম আয় করে ৩৮২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে দাবি পরিশোধ করে ৮৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। বছরটিতে মোটরযান বিমা থেকে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা হয় ১৪০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৮ সালে মোটরযান বিমা থেকে নিট প্রিমিয়াম আয় হয় ৩৬৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর বিপরীতে দাবি পরিশোধ করে ৮৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর বছরটিতে মোটরযান বিমা থেকে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা হয় ১২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মোটরযান বিমা থেকে নিট প্রিমিয়াম আয় হয় ৩৪৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে দাবি পরিশোধ করে ৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর বছরটিতে মোটরযান বিমা থেকে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা হয় ৯৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এর আগে ২০১৬ সালে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো মোটরযান বিমা থেকে নিট প্রিমিয়াম আয় করে ৩২৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে দাবি পরিশোধ করে ৮০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বছরটিতে মোটরযান বিমা থেকে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা হয় ১০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো মোটরযান বিমা পলিসি বিক্রি করেই বছরে মুনাফা করে ১০০ কোটি টাকার ওপরে। ফলে মোটরযান বিমা উঠে যাওয়ার কারণে মোটা অঙ্কের আয় হারানোর পাশাপাশি মোটা অঙ্কের মুনাফাও হারাতে হচ্ছে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর। তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার পর চলতি বছর সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো কী পরিমাণ মোটরযান বিমা পলিসি বিক্রি করেছে এবং এ খাত থেকে কোম্পানিগুলো কী পরিমাণ আয় করেছে সে সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের দাবি, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার পর মোটরযান বিমা ৮০ শতাংশের মতো কমে গেছে। এখন একেবারেই বাধ্য না হলে কেউ মোটরযানের বিমা করছে না। এদিকে বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে (চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত) দেশে নিবন্ধিত মোটরযান ৪৯ লাখ ৭১ হাজার ৫৩৫টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৩৪ লাখ ৬৩ হাজার ৮০৩টি। এর মধ্যে চলতি বছর (নভেম্বর পর্যন্ত) ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫০টি মোটরসাইকেলসহ মোট নতুন মোটরযান নিবন্ধিত হয়েছে ৪ লাখ ২ হাজার ৬৫৭টি। বিআরটিএর নতুন নির্দেশনার আগে এসব নিবন্ধিত মোটরযানের জন্য তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন এসব মোটরযানের জন্য কোনো বিমাই বাধ্যাতামূলক নয়। যোগাযোগ করা হলে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জাহিদ আনোয়ার খান বলেন, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার কারণে আমরা বড় অঙ্কের প্রিমিয়াম আয় হারিয়েছি। আগের মোটরযান বিমা পলিসি বিক্রি করে যে প্রিমিয়াম আয় হতো, এখন তার ১৫-২০ শতাংশে মতো আছে। তিনি বলেন, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার কারণে এখন যানবাহনের বিমা হচ্ছে না বললেই চলে। ব্যাংক বা লিজিং প্রতিষ্ঠান যখন পরিবহনের জন্য ঋণ দেয়, তখন বিমা পলিসির দরকার হয়। শুধু এক্ষেত্রেই কিছু বিমা হচ্ছে। তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেয়ার কারণে শুধু আমরা নয়, সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ বিমা পলিসি বিক্রি করে আমরা যেমন প্রিমিয়াম পাই, সরকার পায় ভ্যাট। এখন মোটরযান বিমা পলিসি বিক্রি না হওয়ার কারণে সরকার এই ভ্যাট পাচ্ছে না। এখন যে যানবাহন চলছে তার বেশিরভাগের কোনো বিমা নেই। এটা (বিমা পলিসি ছাড়া যানবাহন চলাচল করা) পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমরা জানা নেই। পরিবহন চলবে বিমা ছাড়া- এটা চিন্তা করাই যায় না। আমাদের এখানে কেন, কোন যুক্তিতে বিমা তুলে দেয়া হলো তা আমরা বুঝতে পারছি না। এটা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের সিইও তারিক উর রহমান বলেন, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেয়ার কারণে আমাদের ব্যবসায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মোটর ইন্স্যুরেন্স প্রায় ৪০ শতাংশের মতো কমে গেছে। আমরা এটা আবার ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি। এটা সরকার বন্ধ করেছে। এখন সরকারকেই এটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের সিইও মো. ইমাম শাহিন বলেন, মোটরযান বিমা সব কোম্পানির অনেক কমে গেছে। মোটরসাইকেলগুলোর যে বিমা পলিসি বিক্রি হতো তার প্রায় সবটা ছিল তৃতীয়পক্ষের। প্রথমপক্ষের বিমা কিছু এলেও এর সংখ্যা অনেক কম। যারা মনে করেন দামি গাড়ির কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতি হতে পারে, তারা বিমা করছেন। আবার কিছু করপোরেট হাউজ বিমা করছে। পরিবহন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিমা করা লাগে। এসব ক্ষেত্রে কিছু বিমা পলিসি বিক্রি হচ্ছে। বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশেনের (বিআই) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বলেন, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার কারণে বিমা কোম্পানিগুলো ব্যবসা হারাচ্ছে। আবার সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এখন এটা চালুর জন্য পদক্ষেপ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এরই মধ্যে দুটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। হয়তো শিগগির এটার সমাধান হবে। ‘তৃতীয়পক্ষের বিমা থাকার কারণে আগে একজন পথচারী আহত বা নিহত হলে কিছু ক্ষতিপূরণ পেতো। আমরা এখন নতুন প্রস্তাব দিয়েছি এটার নাম তৃতীয়পক্ষ হতে পারে অথবা অন্য নাম দিয়ে চালু করার। এক্ষেত্রে পথচারী আহত বা নিহত হলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা মনে করি এটা থাকা উচিত। বাইরের সব দেশেই আছে।